“ভাঙা ছাদের চাঁদ”
গ্রামের নাম বাগডুবি। উত্তরবঙ্গের এক কোণে ছোট্ট এক গ্রাম, ধানক্ষেত আর কাঁচা রাস্তার মাঝে হারিয়ে যাওয়া সময়ের মতো।
এই গ্রামে থাকত কাফি, পঁচিশ বছরের চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। কলেজ ছাড়ার পর শহরে চাকরি খুঁজে হাল ছেড়ে ফিরে এসেছে। সারাদিন ছোট একটা মুদির দোকানে বসে। সন্ধ্যাবেলা মাঠে বসে আকাশ দেখে।
একদিন হঠাৎ তার দোকানে আসে রিয়া। মুখচেনা ছিল, ছোটবেলায় একসাথে পড়েছে। শহরে থেকে সদ্য ফিরে এসেছে, বাবা মারা গেছেন। মা অসুস্থ। ছায়া পড়ে গেছে চোখে মুখে।
কাফি বলল, “তুই না শহরে ছিলি?”
রিয়া কাঁপা কণ্ঠে বলল, “থাকতে পারিনি আর… শহরের মানুষজন মন খায় কাফি।”
সেইদিনের পর থেকে রিয়া প্রায়ই আসত দোকানে। কখনো লবণ, কখনো বিস্কুট, কখনো কিছুই না… শুধু বসে থাকত কাফির সামনে, নিরবভাবে।
একদিন কাফি বলল, “তুই একা থাকিস?”
রিয়া মাথা নেড়ে বলল, “মা আছে, তবে বিছানায়। আমি রান্না করি, দেখাশোনা করি।”
তারপর থেকে কাফি প্রতিদিন রাতে একটু দুধ আর বিস্কুট পাঠিয়ে দিত রিয়ার জন্য। চুপিচুপি। নাম না জানিয়ে। রিয়া জানত, কিন্তু কিছু বলত না।
একদিন বিকেলে বৃষ্টি হচ্ছিল। রিয়া হঠাৎ এসে বলল, “তোর ছাদে উঠতে পারি?”
কাফি হেসে বলল, “তুই তো আগেও উঠতিস।”
ছাদে উঠল তারা। বৃষ্টির ফোঁটা দুজনের গায়ে পড়ছিল। রিয়া বলল, “তুই জানিস? শহরে আমার কেউ ছিল না। প্রেম করতে চেয়েছিল, শুধু শরীর নিয়ে খেলতে।”
কাফি চুপ করেছিল। তারপর বলল, “আমি তোর শরীর নয়, তোর নিঃশ্বাসকেই ভালোবাসি।”
রিয়ার চোখ ভিজে গেল। বলল, “তুই কথা বলিস কম, কিন্তু কথা বললেই বুক কাঁপে।”
সেদিন প্রথম রিয়া কাফির কাঁধে মাথা রেখেছিল। সেই ভাঙা ছাদে তারা একসাথে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখেছিল, সেই চাঁদ যে শহরের কংক্রিটে হারিয়ে যায়।
কয়েকদিন পর, হঠাৎ রিয়া আর দোকানে এলো না। কাফি খোঁজ নিতে গেল। দরজায় তালা। প্রতিবেশী বলল, “মেয়েটাকে শহরের কাকা এসে নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য।”
মাসখানেক কেটে গেল।
এক সন্ধ্যায় কাফি দোকান বন্ধ করে ছাদে উঠল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ – “চাঁদটা আজও আমাদের জন্যই ওঠে, না?”
সে ফিরে তাকাল। রিয়া। হাতে ছোট একটা ব্যাগ। চোখে পুরনো সেই চাওয়া।
রিয়া বলল, “কাকা অনেক জোর করল, বিয়ের জন্য। আমি পালিয়ে এসেছি। যদি তুই বলিস, আমি থেকে যাই।”
কাফি তার চোখে চোখ রাখল, বলল,
“এই ভাঙা ছাদটাই আমার পৃথিবী, আর তুই তার চাঁদ।”
সেদিন থেকে রিয়া আর ফেরেনি।