🪐🪐🪐🪐
ঢাকার এক কোণে পুরনো এক গলির মধ্যে ছিল ‘রোশনি বৃদ্ধাশ্রম’। এখানে বাস করতেন সমাজের অবহেলিত কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তাদের কেউ সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিল, কেউ আবার নিঃসঙ্গতার তাড়নায় আশ্রয় নিয়েছেন এখানে।
এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেন এক বৃদ্ধ – নাম তাঁর মোঃ রুহুল আমিন। বয়স ৭৫, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে সবসময় একটা পুরোনো ডায়েরি। চুপচাপ বসে থাকতেন বাগানের এক কোনে, যেখানে কিছু হলুদ গাঁদা আর রক্তজবা ফুল ফুটে থাকত।
রুহুল আমিন সাহেবের জীবনে একটিই সন্তান – রায়হান। ছোটবেলায় যাকে ভালোবেসে বড় করেছেন, বই পড়িয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছেন– “তুই একদিন অনেক বড় হবি বাবা”। সেই রায়হান এখন কানাডার এক কোম্পানিতে বড় চাকরি করে। প্রথমে ফোন আসত প্রতি সপ্তাহে, তারপর মাসে একবার, এখন বছরে একবারও না।
একদিন দুপুরে রুহুল আমিন সাহেব চুপচাপ তাঁর ডায়েরির পাতা খুলে লিখতে শুরু করলেন—
---
“প্রিয় রায়হান,
তুই যখন এই চিঠি পড়বি, তখন হয়ত আমি থাকব না। কিন্তু এই কথাগুলো তোর জানা প্রয়োজন ছিল।
তুই যখন ছোট ছিলি, তোর মা প্রায়ই বলত– ‘রায়হান একদিন বাবাকে ছেড়ে যাবে না’। আমি তখন হেসে বলতাম, ‘আমার ছেলে কখনো এমন করব না।’ জানি না কোথায় ভুল করলাম বাবা।
আমি তোকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম, তুই তো হয়ে গেলি ব্যবসায়ী। আমি তোকে সংসারে সুখী দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেই তোকে হারিয়ে ফেললাম।
তুই জানিস, এখন আমি বারান্দায় বসে গাঁদার ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয়, এদেরও একটা গল্প আছে। প্রতিদিন ফুটে, প্রতিদিন ঝরে পড়ে। যেমন তোর বাবা, যাকে তুই একসময় ভালোবাসতিস, এখন ভুলে গেছিস।
তুই জানিস বাবা, বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটা রাতে আমি তোর ছোটবেলার একটা খেলনা কাছে নিয়ে ঘুমাই। তোর সেই লাল রঙের খেলনা গাড়ি, যা তুই একবার বলেছিলি, ‘বাবা, এটা তোমার জন্য রেখে দিব।’ আমি রেখে দিয়েছি, এখনও আছে আমার কাছে।
আজকাল শরীর ভালো যায় না। ওষুধের প্যাকেট শেষ হয়ে আসে, কিন্তু টাকা জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায়। অনেকদিন হলো তোর ছবি দেখি না। বৃদ্ধাশ্রমে সবাই বলে, 'রুহুল সাহেবের ছেলে বিদেশে, বড় লোক, কিন্তু খোঁজ নেয় না।'
আমি তখন হেসে বলি– ‘আমার ছেলে ব্যস্ত। সময় পেলেই আসবে।’ ভিতরে ভিতরে কান্না চেপে রাখি বাবা।
আমি তো শুধু ভালোবাসা চেয়েছিলাম, এতটুকু সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু বুঝলাম, সময় এখন বড়ই ব্যস্ত। বাবাদের জন্য সময় নেই কারও।
যদি কখনো এই চিঠি তোর হাতে পৌঁছে, জানিস, আমি রাগ করি না। শুধু একবার এসে যদি বলতিস, ‘বাবা, আমি এসেছি’, তাহলে হয়ত আমি কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করতাম।
ভালো থাকিস বাবা। আমি তোকে ক্ষমা করে দিলাম।
– তোর বাবা,
মোঃ রুহুল আমিন”
---
এই চিঠি লেখার কয়েকদিন পর, হঠাৎ করেই বৃদ্ধাশ্রমে রুহুল আমিন সাহেব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়া হলেও আর ফেরা হয়নি তাঁর। তাঁর বিছানার পাশেই ছিল চিঠিখানা, এবং সেই লাল খেলনা গাড়িটি।
রায়হান খবর পেয়েছিল বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ছুটে এসেছিল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাবার রেখে যাওয়া সেই চিঠি পড়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল, প্রথমবার।
বাবার মুখটা একবার শেষবারের মতো ছুঁয়ে বলেছিল, “বাবা, আমাকে মাফ করে দিও।”
এরপর রায়হান অনেক কিছু বদলে ফেলেছিল। বৃদ্ধাশ্রমে সে একটা গ্রন্থাগার গড়ে তোলে – “রুহুল স্মৃতি পাঠাগার”, যেখানে কেউ এসে পড়তে পারে, চিঠি লিখতে পারে আপনজনের জন্য। তার বাবার শেষ ইচ্ছা মতো সে সময় দেয় আশ্রমের অন্য বৃদ্ধদের পাশে, যেন তাদের আর একাকীত্বে দিন কাটাতে না হয়।
---
শেষ কথা
মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে চায় একটু ভালোবাসা, একটু সময়। টাকা-পয়সা, বড় চাকরি সবই মূল্যহীন হয়ে যায় যদি কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যায়।
রুহুল আমিন ছিলেন একজন শিক্ষক, একজন বাবা, একজন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক।
আর সেই ‘শেষ চিঠি’ যেন একটি শিক্ষা– সময় থাকতে যাদের ভালোবাসি, তাদের সময় দিই।