নানা ইস্যূ দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বয়ে যাচ্ছে। একটা বিষয় খুব অস্থিরতা তৈরি করছে নিজের মাঝে-গত কয়েকদিন ধরে।
সম্প্রতি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি দেশের ক্ষুদ্র ঋণ (পড়ুন সুদী ক্ষুদ্র ঋণ) এর কার্যক্রম নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃ. এর একটি ইংরেজি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘Micrifinance in Bangladesh-Annual Statistics, June 2024’ । এইটা পড়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম।
প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে অনুমোদিত ও কার্যকর ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এর সংখ্যা মোট ৭২৪টি। এগুলোর সদস্য সংখ্যা ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ (১৭ কোটি জনসংখ্যার হিসাবে)।
সহজে বললে-প্রায় ৪০ %। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জন বাংলাদেশির মধ্যে প্রায় ৩৮ জন এই গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। এতো বিশাল সংখ্যাক জনগোষ্ঠি সুদী ক্ষুদ্র ঋণের জালে আবদ্ধ! (অল্প কিছু এমআরএ ইসলামী হলেও অধিকাংশই সুদী)
BRAC ও ASA-এর সম্মিলিত সুদী ক্ষুদ্র ঋণের বাজার দখল প্রায় ৫১.১০%, অর্থাৎ শুধু দুই প্রতিষ্ঠান মিলে পুরো ME সেক্টরের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে BRAC শীর্ষস্থানে রয়েছে। তাদের ME ঋণ বিতরণ বাজারের প্রায় ৩৪.৫১% দখল করে আছে।
ব্র্যাকের Portfolio Yield (PY) : 23.70%। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা ঋণের বিপরীতে ২৩.৭০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে-দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাদের থেকে।
এতো উচ্চ সুদের ব্যবসা তো সাধারণ ব্যাংকও করতে পারে না। তারা সেই ব্যবসা করে যাচ্ছে দরিদ্র মানুষের সাথে। ক্ষুদ্র ঋণের নামে দরিদ্র মানুষের রক্ষ চোষে যাচ্ছে। ঋণ গ্রহীতারা কতটুকু লাভবান হচ্ছে, সেটি বড় কথা নয়, তাদের পোর্টফোলিও পাহাড়তুল্য হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন!
সরাসরি ঋণ গ্রহীতা থেকেই প্রতি ১০০ টাকায় ২৩.৭০% আয় করছে। ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলে গ্রহীতাকে অতিরিক্ত ২৩৭০ টাকা আদায় করতে হবে। তাদের তথ্যানুসারে এখানে মাত্র ২০০ টাকা (প্রায়) সুদ আয় (অপারেটিং কস্ট বাদ দিলে থাকে 8.48%, সেই হিসাবে উক্ত নিট আয়)। ২১৭০ টাকাই তাদের ভাষায় অপারেটিং কস্ট। এই পুরো খরচ চাপিয়ে দেয়া হয় দরিদ্র ঋণ গ্রহীতার উপর!
এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তারা সব সময় চেষ্টা করে অপারেটিং কস্ট বেশি দেখিয়ে নিট আয় কম দেখাতে। মানুষ যেনো তাদের উচ্চ আয়ে প্রশ্ন উত্থাপন না করতে পারে। মানুষকে বলে- “আমরা তো মুনাফা করছি না, আয় যা হয়, প্রায় সবই খরচে চলে যায়”। মাত্র ২০০ (প্রায়) আয় হচ্ছে।
কিন্তু এখানে সত্য গোপন করার কৌশল রয়েছে। তাদের ভাষায় অপারেটিং কস্ট ১৫.২২%—তবে এটি আসলে একটি ম্যানিপুলেটেড ফিগার হতে পারে। তারা খরচ বেশি দেখায়। যেনো মানুষ তাদের গোপন উচ্চ আয়ে প্রশ্ন করতে না পারে।
দেখুন- ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর “Administrative Expenses”, “Staff Bonus”, “Loan Officer Incentives”, “Training”, “IT Cost”, এমনকি "Lobbying Cost" ইত্যাদিও অপারেটিং খরচ হিসেবে দেখিয়ে থাকে।
কিন্তু বাস্তবে এসব খরচের অনেকাংশই "Corporate Excess", "মুনাফা লুকানোর উপায়", অথবা পরোক্ষভাবে মালিকানার dividend-এ পরিণত হয়।
আরও লক্ষ্য করুন- Operating Self Sufficiency (OSS) 134.62% ও Operating Margin 27.35% এই দুইটি সূচক আসলেই প্রমাণ করে দেয়, তারা শুধু খরচ কভার করছে না, বরং বড় অঙ্কে মুনাফা করছে।
বাস্তবে মুদ্রার উল্টো চিত্র ভিন্ন রকম। তাদের নিট আয় আরও বেশি হয়ে থাকে। তাদের হিসাবে নিট মুনাফা 8.48%-এ সীমাবদ্ধ নয়। এটি না হলেও ১৫-২০% হবে।
কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো "Surplus Allocation", "Contingency Reserve", বা "Unrealized Income" এর মতো অ্যাকাউন্টিং টার্ম ব্যবহার করে প্রকৃত মুনাফার একটি অংশ আড়াল করে রাখে।
ফলে Reported Net Margin কম দেখানো হলেও বাস্তবিক অর্থে "Effective Net Margin" অনেক বেশি হতে পারে—১৫%–২০% বা তার চেয়েও বেশি।
মাত্র কিছুদিন আগে এমআরএ ভবন উদ্বোধন হল। (পড়ুন-প্রতারণা ভবন)
এই সরকার এসব সুদী ক্ষুদ্র ঋণের-প্রধান পৃষ্ঠপোষক-আগে থেকেই।
৪০০ পৃ. এর প্রতিবেদনের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টাসহ অনেকেই এসব সুদী ক্ষুদ্র ঋণের প্রশংসা করেছেন-এগুলো দারিদ্রবিমোচন করে যাচ্ছে। অথচ মুদ্রার উল্টো চিত্র হল-এগুলো দারিদ্র বিমোচনের তুলনায় নিজেদেরকেই সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। এতো বড় একটি প্রতিবেদনে MRA-এর আওতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য Social Impact Assessment অনুপস্থিত।
এতো এতো মাদরাসা, মসজিদের শহর, আলেম-দ্বীনী মানুষের দেশ, অথচ প্রতি ১০০ জনে ৩৭ জন সুদে সম্পৃক্ত!! ভাবা যায়!!
আপনার চারপাশে কেউ এসবে জড়িয়ে থাকলে সচেতন করুন। বিত্তবান ও উদ্যোগীগণ এগিয়ে আসুন-বিকল্প শূন্য সুদ এমএফএস গড়ে তুলুন। সুদের শিরোনামে এসব প্রতারক এমএফএস এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। যারা শূন্য সুদ ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা করছেন তাদের সহায়তা করুন।