ওপেন সোর্স এআই কীভাবে চীনকে হৃদয় এবং বাজারের শেয়ার জিততে সহায়তা করছে
বর্তমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা AI) শুধু প্রযুক্তির উন্নয়নেই নয়, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। AI এর এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষে থাকলেও, চীন দ্রুত তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। বিশেষ করে ওপেন সোর্স AI-এর মাধ্যমে চীন বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রেমীদের হৃদয় জয় করছে এবং একই সঙ্গে বিশাল বাজার শেয়ার অর্জন করছে।
ওপেন সোর্স AI কী?
ওপেন সোর্স AI হলো এমন এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যার সোর্স কোড উন্মুক্ত রাখা হয়। এটি যে কেউ দেখতে, পরিবর্তন করতে এবং উন্নয়ন করতে পারে। যেমন GPT, LLaMA, বা Baichuan-এর কিছু সংস্করণ ওপেন সোর্স হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। এই নীতির ফলে গবেষক, শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তারা কম খরচে বা বিনামূল্যে AI প্রযুক্তি ব্যবহার ও উন্নয়ন করতে পারেন।
চীনের ওপেন সোর্স উদ্যোগ
চীন সরকার ও বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো — যেমন Baidu, Alibaba, SenseTime এবং Huawei — নিজেদের AI মডেল ওপেন সোর্স করছে। Baichuan, InternLM, এবং ChatGLM এর মতো চীনা ওপেন সোর্স ভাষা মডেলগুলো ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এরা ইংরেজির পাশাপাশি চাইনিজ ভাষায় শক্তিশালী পারফর্ম করছে, যা একে বিশ্বজুড়ে বহুভাষাভিত্তিক ব্যবহারে উপযোগী করে তুলছে।
কেন চীন ওপেন সোর্স AI-কে গুরুত্ব দিচ্ছে?
১. বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা: ওপেন সোর্সের মাধ্যমে চীনা AI মডেলগুলো আন্তর্জাতিক ডেভেলপারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এটি এক ধরনের 'সফট পাওয়ার', যা প্রযুক্তির মাধ্যমে চীনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলছে।
২. তৃতীয় বিশ্বের আকর্ষণ: আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো উচ্চমূল্যের পশ্চিমা প্রযুক্তি কেনার সামর্থ্য না রাখলেও ওপেন সোর্স চীনা মডেল ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে।
৩. স্থানীয়করণে সুবিধা: চীনা ওপেন সোর্স মডেলগুলো সহজে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো করে তৈরি করা হচ্ছে, যা মার্কিন মডেলগুলোর তুলনায় অনেক সময় বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
মার্কিন ওপেন সোর্স বনাম চীনা ওপেন সোর্স
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন OpenAI, Google বা Anthropic অনেক সময় নিজেদের উন্নত AI মডেলগুলো সম্পূর্ণ ওপেন রাখে না। তবে চীনা কোম্পানিগুলো কম বাধা দিয়ে তাদের মডেল ওপেন করে দিচ্ছে, যাতে করে বিশ্বের যে কোনো দেশ সহজেই এটি ব্যবহার করতে পারে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ডেভেলপার ও উদ্যোক্তারা চীনা মডেল বেছে নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক প্রভাব
চীনের ওপেন সোর্স কৌশলের ফলে তারা শুধু প্রযুক্তিগত ভাবেই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভবান হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ:
ওপেন সোর্স মডেল ব্যবহার করে গড়ে ওঠা অ্যাপ বা সার্ভিসের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তারা চীনা ক্লাউড সেবা গ্রহণ করছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনা ওপেন সোর্স মডেল নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন করছে, যার ফলে চীনের প্রযুক্তি রপ্তানি ও সেবা বাড়ছে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক
চীন এই ওপেন সোর্স কৌশলকে শুধু অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, বরং কৌশলগত ভাবেও ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ নীতির বিরুদ্ধে এটি একটি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া। ওপেন সোর্সের মাধ্যমে চীন বলছে — “আমরা সবাইকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছি” — যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি উন্মুক্ত মনে হয়।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
তবে চীনের এই ওপেন সোর্স কৌশলের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
নিরাপত্তা ও নজরদারি নিয়ে অনেক দেশ সন্দিহান।
কিছু চীনা মডেলের মান এখনও পশ্চিমা মডেলের তুলনায় দুর্বল।
ওপেন সোর্স হলেও অনেক সময় চীন সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকে এই প্রযুক্তিগুলোর ওপর।
উপসংহার
ওপেন সোর্স AI এখন কেবল একটি প্রযুক্তি কৌশল নয়, বরং একটি বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারকারী হাতিয়ার। চীন অত্যন্ত কৌশলীভাবে এটি ব্যবহার করছে — তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পাশে টানছে, উন্নয়নশীল উদ্যোক্তাদের সহায়তা করছে এবং নিজেদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এই পথেই চীন হৃদয় এবং বাজার দুই-ই জিততে সক্ষম হচ্ছে। তবে এই প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করবে বিশ্ব রাজনীতি ও প্রযুক্তির ভারসাম্যের ওপর।
