গল্প: হারানো দীপ্তি

বাংলাদেশের একটি ছোট্ট গ্রামে থাকত আয়ান নামে এক কিশোর। বয়স তার মাত্র চৌদ্দ বছর। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় ভালো ছিল, বিশেষ করে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি তার ছিল অন্যরকম টান। কিন্তু তার জীবনটা ছিল সংগ্রামের—কারণ তার বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর আর মা গ্রামের মহিলাদের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন।

আয়ান যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, তখন থেকেই সে বুঝতে শুরু করে যে দারিদ্র্য তার জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা। অনেক সময় স্কুলে যাওয়ার মতো খরচও জোগাড় করা যেত না। বই-খাতা কেনার টাকা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু আয়ান স্বপ্ন দেখতে জানত। সে প্রায়ই রাতে আকাশের তারাগুলো দেখে বলত, “একদিন আমি বিজ্ঞানী হবো, মানুষের জন্য কিছু আবিষ্কার করবো।”

সংগ্রামমুখর দিনগুলো

গ্রামের স্কুলটি ছিল খুবই সাধারণ। শিক্ষকরা আন্তরিক হলেও সুযোগ-সুবিধা একেবারেই কম। বইয়ের পাতা ছেঁড়া, বেঞ্চ ভাঙা—এসব নিয়েই পড়াশোনা চলত। তবুও আয়ান সবসময় প্রথম হতো। শিক্ষকরা তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। একদিন গণিতের শিক্ষক তাকে বললেন,

— “আয়ান, তুমি যদি মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাও, একদিন অনেক বড় কিছু করতে পারবে।”

এই কথাগুলো আয়ানের মনে আগুন জ্বালিয়ে দিল। তবে বাস্তবের কষ্টগুলো তাকে প্রায়ই দমিয়ে দিত। একদিন স্কুল থেকে ফিরে সে দেখল তার মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। ওষুধ কেনার টাকা নেই। বাবার হাতে সামান্য কিছু টাকা, কিন্তু তা দিয়ে সংসারের বাজারই হয় না।

সেদিন রাতে আয়ান অনেক কেঁদেছিল। ভেবেছিল, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু মায়ের কণ্ঠে ভরাট আশা শুনে সে থেমে গেল। মা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

— “বাবা, আমরা হয়তো কষ্টে আছি, কিন্তু তুই পড়াশোনা ছাড়বি না। তুই একদিন সফল হবে—আমার এ বিশ্বাস আছে।”

এই কথাই আয়ানকে নতুন করে জেদী করল।

অপ্রত্যাশিত সুযোগ

একদিন স্কুলে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন হলো। প্রতিটি ছাত্রকে একটি করে প্রকল্প বানাতে বলা হলো। আয়ানের হাতে টাকা না থাকলেও সে হাল ছাড়ল না। আশেপাশের ভাঙারি দোকান থেকে পুরনো ব্যাটারি, ভাঙা তার, বাতি কুড়িয়ে আনল। কয়েক রাত না ঘুমিয়ে সে বানাল একটি ছোট্ট বিদ্যুতের প্রজেক্ট—যেখানে ব্যাটারির সাহায্যে একটি বাতি জ্বলে ওঠে।

মেলার দিন যখন তার প্রজেক্ট প্রদর্শিত হলো, সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, এত সামান্য উপকরণ দিয়ে এমন কিছু তৈরি করা সম্ভব! সেই মেলায় জেলা পর্যায়ের একজন শিক্ষা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনি আয়ানকে ডেকে বললেন,

— “তুমি সত্যিই অসাধারণ ছেলে। তোমার মধ্যে বড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

তিনি আয়ানকে একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিলেন।

নতুন দিগন্তে যাত্রা

স্কলারশিপের টাকায় আয়ানের পড়াশোনার কিছুটা সুরাহা হলো। বই-খাতা কেনা সহজ হলো, স্কুলে যাওয়া আর বন্ধ থাকল না। সে আরও মন দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার প্রতিভা সবার চোখে ধরা পড়তে লাগল।

তবে গ্রামে ঈর্ষাও বাড়তে লাগল। কিছু লোক বলত, “দিনমজুরের ছেলে কি আর বিজ্ঞানী হবে? এসব স্বপ্ন কেবল ধনীদের জন্য।”
কিন্তু আয়ান এসব কথায় কর্ণপাত করত না। সে জানত, মানুষের ঈর্ষা তার পথের কাঁটা, কিন্তু সে হাল ছাড়বে না।

চূড়ান্ত পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ

এসএসসি পরীক্ষার সময় কাছাকাছি এলো। পড়াশোনার চাপ বাড়ল। হঠাৎ তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সংসারের বোঝা আরও বেড়ে গেল। আয়ান পড়াশোনার পাশাপাশি রাতে একটি দোকানে কাজ করতে শুরু করল। দিনে স্কুল, রাতে কাজ—তবুও সে পড়াশোনা থামাল না।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন সে রাত জেগে বই পড়ত, তখন মনে হতো, হয়তো সে পারবে না। কিন্তু মায়ের অনুপ্রেরণা আর নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে চালিয়ে নিল।

ফলাফল প্রকাশের দিন, পুরো গ্রাম অবাক হয়ে দেখল—আয়ান জেলায় প্রথম হয়েছে! তার ছবি সংবাদপত্রেও ছাপা হলো। গ্রামবাসী তখন গর্বে বলল, “আমাদের গ্রাম থেকে একজন বড় মেধাবী বের হলো।”

শহরে নতুন জীবন

এসএসসি-র পর আয়ান ঢাকা শহরের একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হলো। প্রথমবার গ্রামের বাইরে এসে সে এক নতুন জগৎ দেখল। বিশাল শহর, উঁচু দালান, উন্নত ল্যাব—সবকিছু তার চোখে নতুন ছিল। তবে এখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। সবাই মেধাবী, সবাই স্বপ্ন দেখে বড় কিছু হওয়ার।

আয়ান প্রথমদিকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শিগগিরই বুঝল—পরিশ্রমই তাকে আলাদা করে তুলবে। প্রতিদিন লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বই পড়ত, ল্যাবে পরীক্ষা করত। শিক্ষকরা তাকে ভালোবাসতেন, সহপাঠীরা সম্মান করত।

কিন্তু দারিদ্র্যের ছায়া এখনো তাকে তাড়া করত। অনেক সময় টিফিন খাওয়ার টাকা থাকত না। বন্ধুদের লুকিয়ে শুধু পানি খেয়ে কাটিয়ে দিত। তবুও সে নিজের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরল।

বড় স্বপ্নের পথে

সময়ের সাথে সাথে আয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো—ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেল। সেখানে গিয়ে তার প্রতিভা আরও বিকশিত হলো। সে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর গবেষণা শুরু করল। তার স্বপ্ন ছিল, গ্রামের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় সস্তায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া।

বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রমের পর আয়ান একটি বিশেষ সোলার সিস্টেম আবিষ্কার করল। যা খুব কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। তার এই আবিষ্কার গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হলো—এবং ফলাফল ছিল আশ্চর্যজনক। অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামগুলো আলোয় ভরে উঠল।

গ্রামের মানুষ যারা একসময় তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত, তারাই এখন তাকে শ্রদ্ধা করে। তার বাবা-মায়ের চোখ ভরে ওঠে আনন্দের অশ্রুতে।

উপসংহার

আয়ান বুঝেছিল, দারিদ্র্য কিংবা কষ্ট কোনোদিনই মানুষের স্বপ্নকে থামাতে পারে না—যদি তার ভেতরে অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকে। আজ সে কেবল নিজের পরিবার নয়, পুরো দেশের জন্য গর্বের প্রতীক।

তার জীবনের মূল শিক্ষা হলো—
👉 কষ্ট যতই আসুক, হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
👉 দারিদ্র্য স্বপ্নকে মুছে দিতে পারে না।
👉 জ্ঞান আর পরিশ্রমই মানুষকে সত্যিকার অর্থে দীপ্ত করে তোল