কৈশোরক বয়স থেকেই ইবরাহীম খাঁর সঙ্গে পরিচয়। সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে আমাদের পাঠ্যবইয়ে একটা গল্প ছিল 'সোনার হরফে লেখা নাম'। ওই গল্পের প্রতি ভাললাগার রেশ যায়নি একবিন্দুও। ইবরাহীম খাঁ'র প্রসঙ্গ উঠলেই বড়মিঞার কথা মনের মধ্যে ভেসে উঠত। বিশেষ করে ওই অংশটার বর্ণনা, যেখানে বন্যার শিকার হয়ে মানুষ ও পোষা প্রাণীর সঙ্গে বন্যপ্রাণীরাও ঠাঁই নিয়েছে এক জায়গায়।
আজও মনে পড়ে, ওই বয়সেই ভেবেছিলাম বিপদের দিনে সবাই যদি একসঙ্গে থাকতে পারে, অন্য সময় কেন নয়? ওই অংশের বর্ণনা গল্পকার এমন সুন্দরভাবে দিয়েছেন যে, বারবার মুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। লিখেছেন : 'অনেকগুলি বাড়ী গেলাম। ঘরের ভিতরে মাচা পেতে তারই উপর অভাগারা কোন রকমে বসে আছে। রাতে ওরই ওপর জড়াজড়ি করে শোয়। মায়ের কোল হতে ঘুমের মধ্যে বাচ্চা হয়তো গড়িয়ে নীচে পড়ে যায়, সকালে উঠে আর তাকে পাওয়া যায় না। অন্ধকারে দড়ির মত গায় বাজে-কি জানি কি! বিষম ঠাণ্ডা !
বোঝে, ও ওদেরই মত বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছে...আঘাত না করলে এখন কিচ্ছু বলবে না। সকালে মাচা হতে নেমে গিয়ে কাছের কোন ধুমচা গাছের ডালে কোন রকমে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে, কেউ ওদের কিছু কয় না। গরুরা দিনের পর দিন গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, কারো কারো বাড়িতে সাঁতার। গিরস্থ গরুর দড়ি খুলে দিয়ে বলছে : যারে যা, যদি পারিস, তবে গিয়ে কোথাও ওঠ। আমি তোদের বাঁচাতে পারলাম না। ওরা অকুল দরিয়া পাড়ি দিতে ভাটি পথে চলে : যতক্ষণ দেখা যায় গিরস্থ এক দৃষ্টে চেয়ে দেখে, তারপর ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়, গিরস্থ বুক চেপে ধরে মাচায় এসে ওঠে। একটা আক গাছ দেখলাম- সাপ ব্যাঙ শিয়াল মুরগী : এ ঘোর বিপদে ওরা হিংসা ভুলে একত্রে বসে আছে।'
একটা গল্প একই সঙ্গে কতদিকে যে আলো ছড়াতে পারে। কত প্রসঙ্গ হাজির করার সক্ষমতা রাখে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই গল্প। ডাংগুলি খেলার বয়সে গল্পের ভেতর-বাহির সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতাম না। আমাদের শিক্ষকেরাও কি বুঝতেন? বোঝার কথাও ছিল না নিশ্চয়। স্মৃতি হাতড়ে তো বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারি না, যা শুনেছি ওই গল্প প্রসঙ্গে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষকের বয়ানে।
পরিস্কার করে বলে নেওয়া ভাল এই গল্পের এখন যে ভাষ্য পাঠ করছি, তার সবটা বোধ করি আমাদের পাঠ্যবইয়ে ছিল না। সংক্ষিপ্তকরণ, সম্পাদন, সংশোধন ও সহজীকরণের নামে উনারা গল্পের যে অংশ আমাদের কাছে হাজির করেছিলেন তাতে গল্পের মূল যে শক্তি, গল্পকারের যে অভীপ্সা তার খামতি রয়ে গিয়েছিল বলে মনে করি। পাঠ্যবইয়ে যে যুক্তি ও কারণ দেখিয়ে গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধ মূলরূপে হাজির করা থেকে বিরত থাকা হয়, তার সঙ্গে একমত হওয়া দুরুহ, অসম্ভবও বটে। হয়তো পরিসর বিবেচনায় সংক্ষিপ্তকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি মূলভাবকে খর্ব বা উপেক্ষা করা হয়, সেটা নিশ্চয় কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ এই কাজটিই হামেশা করে থাকে এদেশের 'এনসিটিবি' নামক প্রতিষ্ঠানটি।
mdalamingazi
टिप्पणी हटाएं
क्या आप वाकई इस टिप्पणी को हटाना चाहते हैं?