যে মানুষ টা আমার না।

আমাদের বর্তমান যুগে এক তরফা ভালোবাসার ফুলঝুড়ি ভর্তি।

 

নাদিয়াকে কথাগুলো বলা একদম ঠিক হয়নি। সে না হয় না বুঝে কিছু কথা বলে ফেলেছে, তাই বলে আমি তাঁর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করলাম। জানালায় দাঁড়িয়ে যখন এসব ভাবছিলাম তখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। আমার জন্য তাকে তাঁর বান্ধবীদের সামনে অপমান হতে হলো। তাঁর বিশ বছরের জীবনে হয়তো আজকের জন্মদিনটাই সবচেয়ে খারাপ ভাবে উৎযাপন করা হলো,তাকে সবার সামনে অপমানিত হতে হলো। অথচ আজকে এই দিনটা তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ জন্মদিন হতে পারতো।

 

শহরটা নীরব হয়ে এসেছে। সবাই চলে গিয়েছে,বাড়িটা ফাকা হয়ে গেছে। নাদিয়া আমার সাথে কোনো কথা বলল না। এমনিতেও খুব একটা কথা বলে না সে আমার সাথে। সবসময় দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কতো দিন আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি তাঁর সাথে ডিনার করবো বলে, কিন্তু কোনোদিন করা হয়নি। সে আমার জন্য কোনোদিন অপেক্ষা করেনি। কতোদিন তাঁর সাথে ব্রেকফাস্ট করবো বলে সকালে ঘুম থেকে উঠেছি কিন্তু সে আমার সাথে খেতো না। আমি চলে যাওয়ার আগে সে ঘুম থেকেই উঠতো না। আমি যাওয়ার পরে সে সকালের খাবার খেতো। বিয়ের পর থেকেই আমরা এক বিছানায় ঘুমালেও আমাদের মাঝখানের দূরত্বটা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। সেটা হোক বাস্তব জীবনে কিংবা বিছানায়।

 

প্রথম দিকে আমাদের মাঝে শুধু একটা নরম তুলতুলে কোল বালিশের ব্যবধান থাকতো। আস্তে আস্তে সে ব্যবধানটা বাড়তে থাকে। একসময় দেখা যায় মাঝখানে কোল বালিশ না হলেও সমস্যা নাই। খাটের দুইপাশে দুইজন দুইদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমাতাম। কখনো কেউ কারো দিকে তাকাতাম না। আমি তাকাতাম না লজ্জায়। সে তাকাতো না হয়তো ঘৃণায়। অথচ এমনও হতো পারতো আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব থাকতো না,সেন্টিমিটার পর্যন্তও ব্যবধান থাকতো না। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় হাজার হাজার রাত কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এমন কিছু শুধু কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে না।

 

আজকে হয়তো নাদিয়া মাঝখানের দূরত্বটা কমানোর জন্য কোলবালিশ দিতে ভুলে গিয়েছে। না দিলেও কিছু হবে না সে জানে। কারণ আমাদের মাঝে এতোটা দূরত্ব আর অভিমান সৃষ্টি হয়েছে যে সামান্য কোলবালিশ টা সরালেই সেটা ঠিক হয়ে যাবে এটা ভাবা ভুল। মেয়েটার ঘুম অনেক পাতলা। মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতাম না একটা মানুষ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে। আমার যেখানে ঘুম আসতে ত্রিশ চল্লিশ মিনিট লেগে যায়,কোনো কোনোদিন দুই তিন ঘন্টাও লেগে যায় তবুও ঘুম আসে না। কিন্তু এই মেয়েটা সবার থেকে আলাদা। বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম অন্ততপক্ষে আজকে সে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারবে না,কারণ তাঁর মনটা আজ ভালো না। আর মন ভালো না থাকলে ঘুমও সহজে আসবে না। কিন্তু না,অন্যদিন এর মতো আজকেও সে খুব কম সময়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

 

আমার সামনে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি পৃৃথিবীর সমস্ত মমতা ভরা ভালোবাসা নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে পৃৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর আর নিষ্পাপ মানুষটা আমার সামনে ঘুমিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে তাঁর কপালে একটু ছুঁয়ে দেই। সিনেমা উপন্যাসে তো অনেক সময় ভালোবাসার মানুষকে জোর করে ভালোবাসে,জোর করে আদর করে। প্রথমে রাগ করলেও পরে ঠিকই আদরটা পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। সমস্ত রাগ,অভিমান ভুলে দুজন দুজনকে ভালোবাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইচ্ছে করছে আমার সামনে শুয়ে থাকা মেয়েটার অমৃতের মতো নরম ঠোঁটে চুমু খাই। 

 

কি এমন ভাববে নাদিয়া? যখন দেখবে এমন একজন মানুষ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে যে মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। তারপর হয়তো আমাকে ধাক্কা দিয়ে অনেক দূরে ফেলে দিবে। কয়েকটা থাপ্পড় মারবে,গালাগাল করবে। আরো অনেক বেশি ঘৃণা করতে থাকবে। এসবের পরেও কেনো জানি নিজেকে সংযত রাখতে পারছি না। তাঁর ওই ঠোঁট দুটো আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। 

 

অনেক কষ্টে নিজেকে এসবের থেকে সংযত রাখলাম। তাঁর বাহিরের সৌন্দর্যের সাথে ভিতরের কোনো মিল নেই। বাহিরে যতটা সুন্দর ভিতরটা হয়তো এতো সুন্দর না। আফসোস ভিতরটা যদি এতো সুন্দর হতো!

 

পৃৃথিবীর সব মানুষই বলবে বাহিরের সৌন্দর্য এর চেয়ে ভিতরের সৌন্দর্যটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায় সবাই সৌন্দর্য এর পুজারি। বাহিরের সৌন্দর্যটাকেই আমরা বেশি প্রাধান্য দেই। আমিও দিয়েছি। এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের স্বামী,স্ত্রী দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু তবুও তারা তাদের দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারে না। দুঃখ, বেদনা তাদের জীবনটাকে ঘিরে ফেলে। একজন আরেকজন এর প্রতি ভুলবোঝাবোঝি হয়েই শেষ মেষ জীবনটা পাড় করতে হয়। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি যাদের বউ অনেক সুন্দরী, তারা তাদের বউকে নিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে থাকতো। এমন অনেককে জানি আমি যারা নিজের থেকে, নিজের বাবা মায়ের থেকে নিজের সুন্দরী বউকে বেশি ভালোবাসতো। বউ এর মন রক্ষার জন্য নিজের মাকে কষ্ট দিতে একবারও ভাবতো না। এতো ভালোবাসার পরেও দেখা যেতো তাদের সুন্দরী বউ তাদেরকে ছেড়ে অন্য কোনো পুরুষের সাথে চলে গিয়েছে। 

 

এমন অনেক পুরুষকে চিনি যারা ঘরে সুন্দরী বউ থাকার পরেও প্রতিরাতে পতিতালয়ে রাত কাটায়। ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়। আবার এমন অনেক পুরুষকেও চিনি আমি যাদের বউ আহামরি কোনো সুন্দরী না,দেখতেও খুব একটা ভালো না। তবুও তারা নিজের বউকে নিয়ে সুখে থাকে,নিজের বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না। অনেক সুন্দরী মেয়ের চেয়ে শ্যামলা কালো বর্ণের মেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করে যায়। নিজের সৌন্দর্য দিয়ে অনেক সুন্দরী তাদের স্বামীকে মুগ্ধ করতে পারেনি। অথচ সৌন্দর্য না থাকার পরেও স্বামীকে নিজের প্রতি মুগ্ধ করেছে অনেক মেয়ে।

 

আমরা একটা জিনিস মনে প্রানে বিশ্বাস করলেও সেটা মানি না। আমরা জানি জীবনে সুখী হতে হলে সুন্দর চেহারার মানুষের চেয়ে সুন্দর মনের মানুষের দরকার। বাহিরের সৌন্দর্য না দেখে ভিতরটাকে দেখা উচিত। কিন্তু আমরা কেউ সেটা করি না। কথায় আছে বাহিরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট। ঘনকালো হরিণীর মতো মায়াবী চোখের প্রেমে পড়তে পারি আমরা,বোঁচা নাকের প্রেমে পড়তে পারি,অমৃতের মতো ঠোঁঠের স্পর্শ পাওয়ার জন্য কারো প্রেমে পড়তে পারি। আকর্ষণীয় ফিগার দেখে জীবনসাথী হিসেবে কল্পনা করতে পারি। কিন্তু মানুষের ভিতরেও যে একটা সুন্দর মন থাকতে পারে এই জিনিসটা আমরা কেউ খুঁজি না। ভিতরের সৌন্দর্য দেখে আমরা কারো প্রেমে পড়তে রাজী না। আমাদের কাছে দেহের সৌন্দর্যটায় আসল।

 

অফিস থেকে ফেরার পথে ফুটপাতে চোখ পড়তেই একটা জিনিস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এক বৃদ্ধ ফুটপাতে বসে একজাতীয় পিঠা ভাঁজছেন, তাঁর বৃদ্ধ বউ তাকে অনবরত সাহায্য করে যাচ্ছেন। কোনো ক্লান্তি নেই,কোনো রাগ নেই দুজন দুজনের ওপর। আমি সেখান থেকে একটা পিঠা নিয়ে বৃদ্ধ লোকটার সাথে কিছু কথা বলে বাসার দিকে রওনা হলাম। অনেক বেশি অবাক হলা যখন জানতে পারলাম প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই ফুটপাতে এভাবে পিঠা বিক্রি করে বেঁচে আছেন তারা। এই দীর্ঘ চল্লিশটি বছরে তাদের জীবনে হয়তো অনেক ঝড়ঝাপটা এসেছে,রাগ অভিমান হয়েছে দুজনের মাঝে। কিন্তু কখনো তারা কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি। এটাই বুঝি রিয়াল লাভ। অথচ আমরা এক বছর প্রেম করেই বলে বেড়াই ছেলেটাকে কিংবা মেয়েটাকে সত্যিই ভালোবাসি আমি। 

 

বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাসায় এসে দেখি নাদিয়া জেগে আছে। তাঁর জেগে থাকার কারণটা বুঝলাম না আমি।

 

আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে আমার।

- বলো। 

- আমার ডিভোর্স চাই। 

- এখন কি আমরা ডিভোর্স থেকে ভালো আছি?

- আমি আপনার থেকে মুক্তি চাই।

- আমি কি অনেক বেশি জ্বালাই তোমাকে?

- এতো কিছু জানি না। আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। 

 

আমি কিছু বললাম না, যে মানুষটা কখনো আমার ছিলো না তাকে হাজার চেষ্টা করেও আটকানো যাবে না। যে চলে যাবার সে যাবেই। তাকে শত চেষ্টা করেও ফেরানো যাবে না। 

 


Salma Akter

274 Blog des postes

commentaires

📲 Download our app for a better experience!