লাল নীল রং পেন্সিল

রং পেন্সিল দিয়ে কত কিছু আঁকা যায় সেই দৃশ্য গুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানুষের মনের ভাব।

 

 

তৃণি ক্লাশ টেনের বায়োলজি ক্লাশটা নিচ্ছিল, ঠিক তখন রায়ানের ফোনটা আসে। যদিও ক্লাশে ফোন ধরা নিষেধ, তবুও তৃণি ফোনটা ধরে। ক্লাশের বাইরে যে টানা বারান্দাটা আছে সেখানে এসে দাঁড়াতেই রায়ানের অধৈর্য গলা পাওয়া যায়, 'কী হয়েছে বলো তো, তিনবার কল দিয়েছিলে দেখলাম। আমি অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ছিলাম।' 

 

তৃণি কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে, 'আসলে কাল তো তুতুনের স্কুলে প্যারেন্টস ডে, আমারই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্কুলের হঠাৎ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, তুমি একটু কষ্ট করে কাল হাফ বেলা ছুটি নাও না?'

 

রায়ানের মেজাজটা খিচড়ে যায়, বিরক্ত গলায় বলে, 'আচ্ছা, তুমি তো জানো আমাকে অফিসে কত বড় একটা দায়িত্ব সামলাতে হয়। তোমার তো আর তা না, স্কুলের আর এমন কি কাজ। তুমি ম্যানেজ করো, আমার পক্ষে অসম্ভব। আর এখন ছাড়ছি, আমি ভীষণ ব্যস্ত।'

 

তৃণি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে, রায়ান না করবে ও জানত, তাও একবার বলে দেখা। ওর স্কুলের এই চাকরিটা যে রায়ানের কাছে খুব একটা দামী কিছু না সেটা ও বোঝে, তাই বুঝি এমন করে বলে। মাথাটা একটু ঝাকিয়ে মন খারাপটা দূর করে আবার ক্লাশে ঢোকে। চিন্তিত মনে ক্লাশ শুরু করে, কাল যে কী করে ছুটি ম্যানেজ করবে! 

 

সেদিন রাতে রায়ানের ফিরতে রাত হয়। এসেই গোসল করে ডিনারে বসে। ওর প্রিয় বিফ কালো ভুনা রান্না করেছে তৃণি। তুতুন বাবার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে, 'বাবা, তোমার প্রিয় কালো ভুনা, মা করেছে।' 

 

রায়ান চোখ মটকে বলে, 'কেন, তোর প্রিয় না? আচ্ছা, তোদের এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্যারেন্ট'স ডে তে যেতেই হয়? তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস, ক্লাশ এইটে পড়িস।'

 

কথাটা বলেই রায়ান আড়চোখে তৃণির দিকে তাকায়। আজ দুপুরে তৃণির সাথে ও একটু বাজে ব্যবহারই করে ফেলেছে। আসলে, অফিসে এত কাজ থাকে যে মাথাটা আউলা হয়ে থাকে।

 

রায়ান আরেকবার চোরাচোখে তৃণির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, নাহ, দেখে তো স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। প্লেট সাজিয়ে দিচ্ছে, মুখটা গম্ভীরও না। তাহলে রাগ করেনি! উম, তৃণির এই একটা ব্যাপার, ও কখনও ওর উপর রাগ করে থাকে না। 

 

রায়ান হালকা গলায় বলে, 'কাল ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে?'

 

তৃণি প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে হাসিমুখেই বলে, 'হ্যাঁ, ম্যানেজ করেছি। বলেছি আমার শাশুড়ী মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।'

 

রায়ান হাসে, বলে, 'বাহ, ভালো করেছ। আচ্ছা, আম্মা খেয়েছে? আম্মা তো গরুর মাংস খায় না, কী দিয়ে খেল?' 

 

তৃণি এবার নিজের প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলে, 'আম্মার জন্য ওনার প্রিয় লাউ দিয়ে মাছ রান্না করে দিয়েছি। একটু আগেই খেল, তুমি তো আজ দেরি করে এলে।'

 

রায়ানের আবার নিজেকে অপরাধী লাগে, নাহ, সকালে অমন রুক্ষ গলায় ওকে না বললেও পারত। 

 

বাসার সব কাজ গুছিয়ে তৃণি যখন বেডরুমে ঢোকে ততক্ষণে ঘড়ির কাটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। তাও ও একটা গল্পের বই নিয়ে বসে, সারাদিনে এই একটু ভেন্টিলেশন ওর। গল্পের বই পড়তে খুবই ভালো লাগে, আর গান গাইতে। কিন্তু সময় কই? ছুটির দিন বিকেলে একবার হলেও গানটা ও চর্চা করে। এক সময় ও কী ভালো গাইত! 

 

রায়ানের আবার বিরক্ত লাগা শুরু হয়েছে, তৃণি এখন বই নিয়ে বসল। ভেবেছিল একটু আদর সোহাগ করে ঘুমিয়ে পড়বে, অথচ তৃণি কিনা গল্প পড়তে শুরু করল! 

 

রায়ান কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়, থাক, আজ এমনিতেই ও তৃণির সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে। কথাটা মনে হতেই রায়ানের আবার ওই কথাটা মনে হয়, আচ্ছা, তৃণি কী কখনও ওর উপর রাগ করে না? মন খারাপ হয় না? 

 

তৃণি এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে, চোখের চশমাটা নাকের ডগায় নেমে এসেছে। তৃণির নাকটা একটু বোচা, আদুরে। রায়ানের হঠাৎ করেই কথাটা জানতে ইচ্ছে করে। একটা কাশি দেয়, তৃণির তাতে মনোযোগে চিড় ধরে না। এবার রায়ান একটু জোরে গলা খাকড়ি দিতেই তৃণি মাথা তোলে, 'পানি খাবে? এনে দেব?' 

 

রায়ান মাথা নাড়ে, 'না, পানি লাগবে না।'

 

তৃণি একটু অবাক গলায় বলে, 'তাহলে? কিছু বলবে?'

 

রায়ান একটা লম্বা নিশ্বাস নেয়, তারপর মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলে, 'আচ্ছা তৃণি, তোমার কখনও মন খারাপ হয় না?'

 

তৃণির চোয়ালটা ঝুলে যায়, আধাশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে। চশমাটা আঙুলের ডগা দিয়ে ঠিক করে, তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, 'হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?'

 

রায়ান একটু থমকায়, দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে, 'এই যে আমি আজ দুপুরে তোমার সাথে কেমন করে কথা বললাম, তুমি তো মন খারাপ করলে না। এর আগেও খেয়াল করেছি, তুমি মন খারাপ করে থাকো না। তোমার কী মন খারাপ হয় না?' 

 

তৃণি এবার হাতের বইটাতে একটা বুক মার্কার দিয়ে বন্ধ করে পাশে রাখে। গভীর চোখে রায়ানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, 'হ্যাঁ, মন খারাপ হয় তো।' 

 

রায়ান অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, 'তাহলে তোমাকে কখনো রাগ করে থাকতে দেখি না কেন? আজকেও হাসিমুখে আমার প্রিয় কালো ভুনা করেছ। মন খারাপ হলে তো বুঝতে পারতাম।' 

 

তৃণি এবার বিছানা থেকে নামে, বইটা পাশের সাইড টেবিলে রেখে ঘুরে তাকায়, বলে, 'আমার মন খারাপ কেউ সহজে বুঝতে পারে না। আমি সবসময় হাসিমুখেই থাকি, মন খারাপ থাকলেও, ভালো থাকলেও।' 

 

কথাটা বলে তৃণি ওয়াশরুমের দিকে যায়। 

 

রায়ান স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। ও এতদিন ভেবে এসেছে তৃণি বুঝি ওর সবকিছু মেনে নেয়, হাসিমুখে থাকে। রাগ যে করে না তা না, কিন্তু খুব দ্রুতই ও স্বাভাবিক হয়ে যায়। এতদিন এটাই দেখে এসেছে। কিন্তু আজ ওর কথায় মনে হলো ও ওর মন খারাপটা বুঝতে দেয় না।

 

তৃণি হাত মুখ ধুয়ে একটু ক্রিম মাখে, একটা সুন্দর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে রুমে। কিন্তু রায়ানের কাছে মনে হয় ক্রিমের ঘ্রাণে ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। 

 

তৃণি লাইটটা অফ করে দিয়ে বলে, 'শুয়ে পড়ো, কাল তোমার আবার অফিস৷ আর আমাকে নিয়ে মন খারাপ করো না, আমি আসলে একজন ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। আমি নিজেই আমার কষ্টটা লুকিয়ে রাখি। আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাই। এই নিয়ে তুমি অযথা ভেব না। ঘুমাও এখন।' 

 

রায়ান কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। এই এত বছর পর ও তৃণির একটা কষ্টের দিক দেখল। ওর কাছে এতদিন মনে হতো, ও খুব ভাগ্যবান যে এমন হাসিখুশি একটা মানুষ পেয়েছে ওর পাশে। ও যেমন হুট করেই রেগে যায় তাতে তৃণির মতো একজন মানুষ পাশে না পেলে সংসারটাই বুঝি টিকত না।

 

কিন্তু তৃণির যে সত্যিই মন খারাপ হয়। তাহলে ও জানবে কী করে? ওর মন খারাপের উপাদান তো শুধু ও একা না, আশেপাশের আরও অনেকেই নিশ্চয়ই আছে। ও যখন কষ্ট দেবে তখন না হয় বুঝতে পারবে, অন্য কেউ দিলে তখন? দিশেহারা বোধ করে রায়ান। সেদিন রাতে ভালো ঘুম হয় না ওর। একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে ওকে। এতটা দিন তৃণিকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পারার কষ্টটা ওকে ঘিরে ধরে।

 

সকালে প্রতিদিনের নিয়ম মেনেই দিন শুরু হয়। 

 

রায়ান সেদিন অফিসে কাজে মন বসাতে পারে না। কিছুক্ষণ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখে, ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের বৈশিষ্ট্য। কী করে এদের একটু বোঝা যায় তার উপায়গুলো। পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় আসে রায়ানের। হুম, একটা সহজ উপায় আছে তৃণির মন খারাপ বোঝার।

 

আজ সন্ধ্যাতেই রায়ান বাসায় ফেরে। তুতুন দরজা খুলে দিতেই অবাক গলায় বলে, 'বাবা, আজ এত তাড়াতাড়ি? আর তোমার হাতে এটা কী?'

 

রায়ান মুখে আঙুল চাপা দিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করে, তারপর ফিসফিস করে বলে, 'তোর আম্মুর জন্য গিফট এনেছি।'

 

তুতুন হাসে, এই বাবাটাকে ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাবা মাঝে মাঝেই খুব রেগে যায়, তখন তুতুনের খুব ভয় করে।

 

রাতে যখন তুতুন ঘুমিয়ে পড়ে রায়ান গিফট বের করে তৃণির হাতে দেয়। তৃণি অবাক চোখে তাকিয়ে জিনিসটা নিয়ে বলে, 'কী এটা?'

 

রায়ান হেসে বলে, 'রঙপেন্সিল আর ডায়েরি।'

 

তৃণি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে, 'তুতুনের জন্য? তা ওর হাতেই দিলে পারতে।'

 

রায়ান মাথা নেড়ে বলে, 'না, তোমার জন্য এটা।'

 

তৃণি ভ্রু কুঁচকে বলে, 'আমার জন্য রঙপেন্সিল! তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?'

 

রায়ানের মুখটা এবার গম্ভীর হয়, বলে, 'মাথা ঠিক আছে। শোন, আজ থেকে যখনই তোমার মন খারাপ হবে এই ডায়েরিটাতে নীল রঙ দিয়ে দাগ দেবে। আর মন ভালো থাকলে লাল রঙের দাগ কাটবে।' 

 

রায়ানের কথায় হেসে ফেলে তৃণি, হাসতে হাসতে বলে, 'কী ছেলেমানুষী কথা বলছ! মন খারাপ থাকলে ডায়েরিতে দাগ কাটব? আহা, তুমি কাল আমার কথা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছ। শোন, আমার মন খারাপ বুঝতে না পারাতে তোমার খুব একটা দোষ নেই। আমরা অন্তর্মুখী মানুষ যারা তাদের নিজেদের দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি। যাও, এটা তুতুনকে দিয়ে দিও কাল।' 

 

রায়ান জোরে মাথা নাড়ে, বলে, 'না, আমি যা বললাম তুমি তাই করবে। আর দাগ তো তোমার ডায়েরিতেই রইল যেটা শুধু আমিই দেখতে পাব। তুমি ডায়েরিটা আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখে দিও।' 

 

তৃণি এরপর যতই না করে রায়ান ততই জোর করতে থাকে। একটা সময় তৃণি বলে, 'আচ্ছা, দেখা যাবে। তুমি এখন ঘুমাও তো।'

 

এর কিছুদিন পর এক বিকেলে তৃণি বারান্দায় বসে ছিল। আজ ওর মনটা অনেক খারাপ, সকাল থেকেই। কিন্তু যথারীতি কেউ বুঝতে পারছে না। তৃণির একটু অসহায় লাগে, ও কেন এমন? নিজের কষ্টের কথা কাউকেই বলতে ইচ্ছে করে না। কাউকে বললে হয়ত ভালোই লাগত। কিন্তু একটা সংকোচ ঘিরে ধরে সবসময়। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই তৃণি ঠোঁট কামড়ে ধরে। একটু ভাবে, তারপর আলমারি থেকে রায়ানের দেওয়া সেই ডায়েরি আর রঙপেন্সিল বের করে। 

 

ডায়েরির পাতা খোলে, সাদা ধবধবে কাগজ। তৃণি একটা রঙপেন্সিল দিয়ে একটা লম্বা দাগ দেয়। তারপর উপরে আজকের তারিখটা লিখে দাগটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদা কাগজে দাগটা কেমন বেশি বেশি ফুটে ওঠেছে। 

 

দাগটা দেবার পর কেমন জানি একটা শান্তি শান্তি লাগে ওর। মনে হচ্ছে ডায়েরিটা ওর আপন কেউ, যাকে নিঃসংকোচে ওর মনের কষ্টের কথা বলা যায়। যে ওর কষ্টটা নিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বলবে না, অথবা কখনও ওকে এই কষ্টের কথা মনে করিয়ে ছোট করবে না। 

 

এরপর থেকে তৃণি এই রঙপেন্সিল দিয়ে দাগ দেওয়ার কাজে খুব মজা পেয়ে যায়। আস্তে আস্তে পৃষ্ঠাগুলো লাল নীল রঙে ভরে ওঠতে থাকে। আর সেই সাথে ডায়েরিটাও ওর একটা বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠে। মনে মনে রায়ানকে থ্যাংক্স দেয়।

 

সেদিন ছুটির দিন। রায়ান দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমোয়, সপ্তাহের এই একটা দিন ও দুপুরে ঘুমোতে পারে। তৃণি তুতুনকে নিয়ে একটু পার্লারে গেছে। ঘরটা কেমন শুনশান, নিঃশব্দে এসি চলছে। রায়ান একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

 

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও বলতে পারবে না, হঠাৎ করেই তীব্র গরমে ঘুমটা ভেঙে যায়। অস্বস্তির সাথে গায়ের কাঁথাটা সরায়, সারা শরীর ঘেমে গেছে। কেমন একটা চটচটে ভাব গায়ে। রায়ান বিরক্তির সাথে খেয়াল করে এসিটা বন্ধ, তার মানে বিদ্যুৎ নেই। ফ্যানটা ঘুরছে কিন্তু এই গরমে কিছুই হচ্ছে না। তাহলে বিদ্যুৎ গিয়েছে অনেকক্ষণ হবে। রায়ান ঘড়িতে তাকিয়েই বুঝতে পারে ও পাক্কা দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে জানালা খুলে দিতেই দেখে বিকেল হয়ে গেছে প্রায়। 

 

রায়ান হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবে তৃণিরা কখন আসবে? ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন দিতে যেয়েও থেমে যায়। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা, তৃণির সেই ডায়েরিটা তো আর দেখা হলো না। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ও খুলে দেখেছিল, সাদা কাগজ, কোনো দাগ ছিল না। 

 

কী মনে হতে রায়ান আলমারিটা খুলে ডায়েরিটা বের করে। পাতা উল্টাতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, পৃষ্ঠা জুড়ে লাল নীল দাগে ভরে গেছে। রায়ান নিশ্বাস বন্ধ করে পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে থাকে। বেশিরভাগই লাল দাগ, একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রায়ান। যাক, নীল দাগ অল্প কয়েকটা। আর সব লাল দাগ। তার মানে এখন খুব কম দিনই তৃণির মন খারাপ থাকে। মনটা ভালো হয়ে যায় রায়ানের। আজ তৃণি আসলে ওকে জিজ্ঞেস করবে, অল্প যে কয়টা নীল দাগ আছে সেটা কেন? ও ওর সব কষ্টের নীল দাগ আনন্দের লাল দাগে পালটে দেবে।

 

তৃণি আর তুতুন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। তুতুন চুল কেটেছে, মেয়েটাকে এখন অন্যরকম লাগছে। রায়ান তৃণির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে, 'তুমি আজ চুল কাটোনি? তুতুনকে তো ভালো লাগছে।'

 

তৃণি একটু অবাক হয়, রায়ান সাধারণত এমন কথা কম বলে। ও লাজুক গলায় হেসে বলে, 'নাহ, এই বয়সে আর চুল কেটে কি হবে।' 

 

রায়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, তৃণি কি মন খারাপ থেকে কথাটা বলল?

 

সেদিন রাতে তৃণি যখন ঘুমোতে আসে রায়ান ওর হাতটা ধরে নরম গলায় বলে, 'তৃণি, আজ আমি তোমার ডায়েরিটা দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে, তুমি ডায়েরিতে দাগ কেটেছ। আরও ভালো লেগেছে নীল দাগগুলো অনেক কম দেখে। আমি এই কম নীল দাগগুলোও রাখব না, সব লালে পালটে দেব।' 

 

তৃণি একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়, ঠোঁট চেপে ভাবে, রায়ান ওর ডায়েরিটা দেখেছে! 

 

নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, 'কিছু কষ্ট না থাকলে তো জীবনে আনন্দের কোনো মানে নেই। থাকুক না কিছু নীল দাগ।'

 

রায়ান গভীর আবেগ নিয়ে বলে, 'তাও আমাকে বলো, ওই নীল দাগগুলো কেন? আমি কী কষ্ট দিয়েছি এর মাঝে?'

 

তৃণি জোর করে হেসে বলে, 'তুমি না এমন করো। ওগুলো কলিগ যারা তারা কষ্ট দিয়েছে। তুমি না।'

 

রায়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, যাক, এতদিনে ও একটু একটু করে তৃণিকে সত্যিকারের বুঝতে পারছে।

 

সেদিন রাতে রায়ান ঘুমোতে যাবার আগে টিভিটা দেখার জন্য রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি ছাড়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু টিভিটা চলে না। রায়ান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর রিমোটের পেছনটা খুলে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। একটু উঁচু গলায় বলে, 'রিমোটে ব্যাটারিগুলা কে উলটো করে লাগিয়েছে? অদ্ভুত।'

 

কথাটা বলে ও ব্যাটারিগুলো খুলে ঠিক করে লাগাতে যেতেই হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হয়। আচ্ছা, তৃণি আবার লাল নীল দাগ দিতে যেয়ে উল্টোটা দেয়নি তো? মানে, যেখানে কষ্ট পেলে নীল দাগ দেবার কথা সেখানে লাল দাগ? 

 

কথাটা মনে হতেই রায়ানের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে, তলপেটটা কেমন খালি হয়ে যেতে থাকে। যদি তাই হয়, তাহলে তো বেশির ভাগ দিন ওর মন খারাপ ছিল?

 

ভাবনাটা স্বস্তি দেয় না ওকে। তৃণি সব কাজ গুছিয়ে রুমে আসতেই রায়ান এবার শক্ত করে ওর দুই বাহু চেপে ধরে৷ তারপর আকুল গলায় বলে, 'তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?'

 

তৃণি হকচকিয়ে যায় রায়ানের হঠাৎ এমন করে বলাতে। উৎকন্ঠা নিয়ে বলে, 'কী হয়েছে বলো তো, তুমি এমন করছ কেন? কী সত্য বলব?'

 

রায়ান এবার এক ঝটকায় আলমারিটা খুলে, তারপর ডায়েরিটা বের করে বলে, 'তুমি আমার মাথায় হাত রেখে বলো তো, এই লাল দাগগুলো কী আসলেই আনন্দের নাকি মন খারাপের? তুমি কী ইচ্ছে করেই নীল দাগের জায়গায় লাল দাগ দিয়েছ?'

 

তৃণির পা টা দূর্বল হয়ে আসে, বুকটা ধুকধুক করছে। ঠোঁট দুটো জোরে কামড়ে ধরে, চোখটা কেমন জ্বালা করে ওঠে। এই প্রথম রায়ান সত্যিকারের আকুল হয়ে জানতে চাচ্ছে ওর মন খারাপের খবরের কথা। কী বলবে ও?

 

তৃণি ভাঙা গলায় বলে, 'হ্যাঁ, তুমি ঠিক ধরেছ। লাল দাগগুলো আসলে নীল দাগ হবে। আমি তো অন্তর্মুখী মানুষ, কষ্টটা সবার কাছ থেকেই লুকাই, ডায়েরিতেও আমি নিজেকে লুকিয়েছি, উল্টো রঙের দাগ দিয়েছি।'

 

রায়ানের বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে, তৃণির তাহলে এত এত মন খারাপ হয়? এত এত কষ্ট? আর ও কি না লাল দাগ দেখে খু্শি হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু তৃণির এত এত মন খারাপের খবর ও জানে না কেন? 

 

রায়ান এবার তৃণির দুবাহু ধরে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলে, 'তৃণি, আজ তোমাকে বলতেই হবে তোমার এত এত মন খারাপ কেন? প্রত্যেকটা লাল দাগের পেছনে তোমার কী কষ্ট লুকিয়ে আছে আমাকে বলো, প্লিজ। আর চেপে রেখো না। আমি তো তোমাকে কষ্ট দেই না।'

 

তৃণি এবার স্থির চোখে রায়ানের দিকে তাকায়, তারপর ম্লান হেসে বলে, 'এটাই তো সমস্যা, তুমি বুঝতেই পারো না তোমার কথা, আচরণ আমাকে কষ্ট দিল কিনা। তুমি আজ যখন এত আকুল হয়ে জানতেই চাইলে তাহলে বলি, এই যে আমার স্কুলের চাকরিটা নিয়ে তুমি প্রায়ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো, যেন আমার চাকরিটা চাকরিই না। মানছি তুমি অনেক বড় সরকারি চাকরি করো, কিন্তু আমাকে এমন করলে কষ্ট লাগে না! 

 

সেদিন আমার বাবার বাসায় দাওয়াত ছিল, তুমি তো যেতেও চাও না। তাও আমার জোরাজোরিতে গেলে, কিন্তু কী করলে? মা অমন উৎসাহ নিয়ে ভুঁড়ি রান্না করেছে আর তুমি নাক কুঁচকে এমন একটা কথা বললে যেন ছোটলোক আমরা। কষ্ট লাগে না রায়ান!

 

এই যে আমি গান করতে ভালোবাসি, অথচ তোমার মা এটা পছন্দ করে না, আমি আমার রুমে দরজা বন্ধ করে সপ্তাহে একবার প্রাকটিস করি। নিজের বাসায় আমি নিজেই বন্দী।

 

আবার, এই যে আমি রাতে কাজ শেষে একটু গল্পের বই পড়ি, বুঝি তোমার পছন্দ না। তুমি চাও আমি তোমার আহবানে সাড়া দিয়ে শারীরিক তৃপ্তিটা মিটিয়ে দেই। শরীর খারাপ থাকলেও তুমি শোননি। মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কতবার এই কাজটা আমাকে করতে হয়েছে তার খবর তুমি কী রাখো?

 

তোমার কাছে এগুলো খুব স্বাভাবিক মনে হয়, তাই হয়ত তুমি বুঝতেও পারো না আমার মন খারাপের কথা।'

 

রায়ান তৃণির বাহু দুটো ছেড়ে দেয়, ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। মুখটা নীচু করে থাকে, হঠাৎ করেই নিজের কদর্য চেহারাটা যেন ও দেখতে পায় যেটা এতদিন কখনও ওর চোখে পড়ে নাই। হ্যাঁ, তৃণি ঠিক বলেছে, ও এতদিন ওর এসব ব্যবহার স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে। কিন্তু ওপাশের মানুষটার যে কতটা খারাপ লাগছে তা কখনও এমন করে ভেবে দেখেনি। নিজেকে আজ ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। এমন করে এতটা বছর ও তৃণিকে কষ্ট দিয়ে আসছে? কী করে তৃণির কাছে আজ ক্ষমা চাইবে ও?

 

রায়ান এবার মুখটা তোলে, দেখে তৃণি কাঁদছে। ও দাঁড়িয়ে এবার তৃণিকে জড়িয়ে ধরে, ব্যাকুল গলায় বলে, 'তৃণি, তুমি আমাকে একটাবার সুযোগ দেবে? আমি তোমার সব সত্যিকারের মন খারাপের নীল রঙগুলো ভালোবেসে আনন্দের লাল রঙে পালটে দিতে চাই। একটাবার রঙপেন্সিলগুলো দেবে আমায়?'

 

তৃণি বুকের ভেতর একটা তোলপাড় টের পায়, আজ বহুদিন পর ওর কষ্টের হিমবাহ যেন গলে যেতে থাকে। দুটো হাত দিয়ে রায়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে আর ফিসফিস করে বলে, 'আমার রঙপেন্সিল তোমাকে দিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। তুমি যেমন আঁকো, আমি তেমনই থাকি।'

 

সেদিনের পর থেকে তৃণির ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠাগুলো সত্যিকারের আনন্দের লাল রঙে ভরে ওঠে। 


Tanvir Arafat

93 ব্লগ পোস্ট

মন্তব্য