সেই দিনই রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় অপরূপ সুন্দর পোশাকে সেজে আর কয়েকটি “পারমা” ভায়লেট ফুল কোটের বুকে স্টুডে ডোরিয়েন গ্রে লেডি নরবোরোর বাড়িতে এসে হাজির হলেন; ভদ্রমহিলার চাকররা সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে তাঁর বসার ঘরে নিয়ে গেল। তাঁর কপালের শিরাগুলি তখন ধকধক করছে; একটা ভীষণ উত্তেজনা বুকের মধ্যে নাচানাচি করছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তিনি গৃহস্বামিনীর হাতটি চুম্বন করার জন্য ঝুঁকে পড়লেন তখন মনে হল সেই চিরাচরিত, সুন্দর, নিষ্পাপ ডোরিয়েন গ্রে ছাড়া আর তিনি নন। সম্ভবত, কোনো অভিনেতাই অভিনয় করার সময় এতটা সাবলীল হতে পারেন না। সেদিন রাত্রিতে কেউ যদি ডোরিয়েন গ্রেকে ভালোভাবে লক্ষ করতে তাহলে সে কিছুতেই বুঝতে পারত না যে তাঁর জীবনে কিছুক্ষণ আগেই এমন একটি ভয়ঙ্কর ট্র্যাজিডি নেমে। এসেছে যাকে আমাদের আধুনিক যুগের যে কোনো ট্র্যাজিডির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ওই সুন্দর আঙুলগুলি পাপ কাজ করার জন্যে কখনো ছুরি ধরতে পারে, অথবা ওই সুস্মিত ঠোঁট দুটি কখনো ভগবানের বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে ডেহাদ ঘোষণা করতে পারে একথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। নিজের শান্ত ভাব দেখে তিনি নিজেই কেমন যেন বিস্মিত হয়ে গেলে এবং এই দ্বৈত জীবনের জন্যে মুহূর্তের জন্যে তিনি যে একটা নির্মম আনন্দও পেলেন না সেকথাও সত্যি নয়।
পার্টিটা খুব ছোটোই ছিল। লেডি নরবোরো খুব তাড়াতাড়িই আয়োজনটি করেছিলেন। অত্যন্ত চতুর ছিলেন লেডি নুরবোরো। লর্ড হেনরির ভাষায় এই জাতীয় মহিলারা হচ্ছেন সত্যিকার কুৎসিত আদর্শের উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যবহারিক জীবনে একটি অসামাজিক রাষ্ট্রদূতের তিনি ছিলেন সুযোগ্য পত্নী। স্বামীর কবরের ওপরে তিনি একটি মর্মর সৌধ নির্মাণ করিয়েছিলেন; এই সৌধের পরিকল্পনা তাঁর নিজেরই। তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন বস্তু ভদ্রলোকদের সঙ্গে। এইভাবে আদর্শ পত্নী আজ জননীর কর্তব্য শেষ করে। বর্তমানে তিনি সময় কাটান ফরাসি উপন্যাস পড়ে, ফরাসি রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে, আর সুযোগ পেলে ফরাসি মদ্যপান করে।
তাঁর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের মধ্যে ডোরিয়েন ছিলেন বিশেষতম এবং ভদ্রমহিলা তাঁকে সব সময়েই বলতেন যে যৌবনে যে তাঁদের পরিচয় হয়নি এতে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি বলতেন: আমি জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হলে উন্মাদের মতো তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলতাম; আর তোমার জন্যে সব কিছু ছাড়তাম আমি। খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে তখন। তোমরা কথা আমার মনে হয়নি। আসল কথা হচ্ছে আমাদের যুগটা এতই অখাদ্য আর শাসন এতই কড়া ছিল যে কারো সঙ্গে যে একটু প্রেম করব সে-সুযোগও আসেনি আমার। অবশ্য সবটাই রবোরোর দোষ। তার দৃষ্টির প্রসারতা ছিল না; আর যে স্বামী কিছুই দেখে না তাকে বিয়ে করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কেউ প্রায় প্রাণ খুলে আসর জমাতে পারেননি। এর কারণটা নোংরা ফ্যান-এর আড়ালে তিনি অবশ্য ডোরিয়েনকে বলেছিলেন। কারণটা হচ্ছে সেদিনই তাঁর একটি বিবাহিতা কন্যা হঠাৎ তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে তার চেয়েও খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে সেই কন্যাটি তার স্বামীটিকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
ঠিক এই সময় মেয়েটার এখানে আসাটা ঠিক হয়নি, বুঝতে পারছি; অবশ্য আমি হামবার্গ থেকে ফিরে প্রতিটি গ্রীষ্মে ওদের বাড়িতে গিয়ে ক’টা দিন কাটিযে আসি; কিন্তু আমার মতো বৃদ্ধা মহিলার মাঝে-মাঝে ফাঁকায় থাকাটা দরকার; আর তা ছাড়া, আমি তাদের কিছুটা চাঙ্গা করে তুলি। ওরা যে কী ভাবে দিন কাটায তা তুমি জান না। যাকে বলে একেবারে নির্ভেজাল গ্রাম্য জীবন। সংসারে অনেক কাডই ওদের করতে হয়; তাই ওরা খুব সকালে উঠে পড়ে; গভীর কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের নেই। তাই ওরা সন্ধে-সন্ধে ঘুমিয়ে পড়ে। রানি। এলিজাবেথের সময় থেকে ও অঞ্চলে কারো কোনো কলঙ্ক রটনি; ফলে ডিনার খেয়েই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের কারো পাশেই তোমার বসার দরকার নেই; তুমি বসবে আমার পাশে, আনন্দ দেবে আমাকে।
একটু হেসে ডোরিয়েন তাঁর বদান্যতার স্বীকৃতি জানালেন, তারপরে, ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ভদ্রমহিলা সত্যি কথাই বলেছেন। আসরটা মোটেই জমাট বাঁধেনি। আগন্তকদের মধ্যে দুজন তাঁর অপরিচিত