. যুদ্ধ রথ

ওয়ারলক / মূল : উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : শাহজাহান মানিক
অনুবাদ সহযোগী – পপি আখতার
উৎসর্গ – রাজিব ও লন্ডন প্রবাস??

একটা দীর্ঘ সোজা সর্পের ন্যায় এক সারি যুদ্ধ রথ উপত্যকাটির বুক চিড়ে খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে চলছিল। অগ্রবর্তী রথ চালকের ঠিক পিছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পর্বতমালার দিকে চোখ তুলে তাকাল। উঁচু শৃঙ্গগুলো বৃদ্ধ মানুষের সমাধিতে পূর্ণ; আর তাদের নিরেট প্রস্তুর গহ্বরগুলো যেন সমাধিগুলোর উন্মুক্ত প্রবেশ দ্বার। প্রাচীন রোমের নির্দয় সৈন্যবাহিনী জিনদের ন্যায় কৃপাহীন দৃষ্টি নিয়ে সেই কালো গহ্বরসমূহ বুঝি তার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ে রাজপুত্র নেফার মেমনন কেঁপে উঠল এবং দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিল। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাত দিয়ে শূন্যে শয়তান তাড়ানোর পবিত্র চিহ্নটা সে আঁকল।

 

ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের সারিবদ্ধ রথগুলোর উদ্দেশ্যে সে দৃষ্টি বুলাল এবং দেখল ধুলোর মেঘের মধ্য দিয়ে ঠিক পিছনের রথে দাঁড়িয়ে টাইটা তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। বৃদ্ধ লোকটিকে ধুলোর কুন্ডলী ঘিরে আছে; তার যানের উপর পাতলা একটা ধুলোর ধূসর আস্তর পড়েছে আর যে এক ফালি সূর্য রশ্মি এই গভীর উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করছে তাতেই ধুলোর ধূসর কণাগুলো চমকাচ্ছিল, যেন কোন দেবদূতের মতোই দীপ্যমান। অপরাধীর ন্যায় নেফার মাথা নিচু করল। বৃদ্ধ লোকটি তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়টা প্রত্যক্ষ করেছে ভেবে সে লজ্জা পেল। ট্যামোস হাউজের কোন রাজপুত্রকে এরকম দুর্বলতা দেখানো উচিত নয়, আর যৌবনের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েতো অবশ্যই আরো না। কিন্তু অন্য সবার চাইতে টাইটা তাকে খুব বেশি জানে, নেফারের শিশুকাল থেকে সে তার শিক্ষক বাবা-মা, ভাইবোনদের চেয়েও আরো বেশি কাছের। টাইটার অভিব্যক্তি কখনোই পরিবর্তিত হয় না, এমনকি এতো দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও তার প্রাচীন দৃষ্টি যেন নেফারের সত্তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। দেখেই সব বুঝে ফেলে।

 

নেফার ঘুরে তার পিতার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার পিতা তখন ঘোড়ার লাগাম ধরে চাবুক পিটিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে উপত্যকার মাঝে গালালা শহরের ভগ্ন-কঠিন সমতল ভূমিটা তাদের সামনে উন্মোচিত হল। প্রথম দর্শনেই এই বিখ্যাত রণক্ষেত্র নেফারকে শিহরিত করল। যৌবনে এখানে টাইটা যুদ্ধ করেছিল। তখন নরদেবতা দেবতা ট্যানোস, লর্ড হারাব অপ শক্তিকে ধ্বংস করেছিল যা কিনা তখন মিশরের জন্যে চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাও তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা, কিন্তু এখনো টাইটার কাছে সব জীবন্ত, আর সে এতো সুনিপুণভাবে সেই যুদ্ধের গল্প নেফারকে শোনায় যে মনে হয় যেন সে নিজেই দুর্দশার ঐসব দিনে সেখানে ছিল।

 

নেফারের পিতা, প্রভু ফারাও ট্যামোস, ভগ্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ঘোড়ার লাগাম টেনে রথ থামালেন। তাদের পিছনে একশ রথও ঠিক একই ভাবে থামাল এবং রথ আরোহীরা পাদানী থেকে নেমে ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কথা বলার জন্যে মুখ খুলতেই ফারাও-এর চিবুক থেকে ধুলোর আস্তর গড়িয়ে তার বুকের উপর ঝরে পড়ল।

 

মাই লর্ড! ফারাও মিশরের মহান সিংহ লর্ড নাজা, তার সেনাপতি ও প্রিয় সহচরকে সম্ভাষণ করে বললেন, সূর্য ঐ পর্বত চূড়া স্পর্শ করার পূর্বেই আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করতে চাই। আমি আশা করছি রাতের মধ্যেই আমরা এল গাবারের বালিয়াড়িটা পাড়ি দিতে পারবো।

 

লালচে ধুলোর আস্তর পড়া সত্ত্বেও ট্যামোসের মাথায় পরিহিত যুদ্ধের নীল মুকুটটা চকচক করছিল। সে নেফারের দিকে তাকাল, তার চোখের কোনায় অশ্রুর ফোঁটা আর ধুলোর কাদা মিলে রক্তাভ একটা পিন্ড তৈরি করেছে। তোমাকে আমি এখানে টাইটার কাছে রেখে যাচ্ছি।

 

যদিও জানে প্রতিবাদ করাটা বৃথা তবুও সে মুখ খুলতে চাইল। অশ্বারোহী দল শত্রুর বিরুদ্ধে চলছে। ফারাও ট্যামোসের যুদ্ধ পরিকল্পনা হচ্ছে দক্ষিণ থেকে চক্রাকারে বৃহৎ বালিয়াড়িটির মধ্য দিয়ে এবং তিক্ত ন্যাট্রন হ্রদের মাঝে একটা পথ তৈরি করে শত্রুদের অতর্কিতে তাড়িয়ে আনরাব-এর পূর্বে নীল নদের তীরে নিয়ে আসা, যেখানে মিশরীয় সৈন্যবাহিনী জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে। পুনরায় শত্রুরা সজ্জিত হওয়ার পূর্বেই ট্যামোস তখন সৈন্যদল দুটিকে একত্রিত করে তেল-আল দাবার বাইরে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে এভারিসের শত্ৰু দুৰ্গটা দখল করে নেবেন।

 

এটি একটি দৃঢ় এবং অসাধারণ পরিকল্পনা। যদি পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে এক ঢিলে দুই প্রজন্ম ধরে চলে আসা হিকদের সাথে লড়াইটা সহজ হয়ে যাবে। নেফার শিখেছে যুদ্ধ ও যশ হচ্ছে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়। কিন্তু, এই চৌদ্দ বছর বয়সেও তারা তাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মনে-প্রাণে সে চাচ্ছে পিতার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ও অমরত্বটা অর্জন করতে।

 

নেফার কিছু বলার পূর্বেই ফারাও তাকে থামিয়ে দিলেন। একজন যোদ্ধার প্রথম কর্তব্য কি? তিনি ছেলের কাছে জানতে চাইলেন।

 

নেফার চোখ নামিয়ে নরম ও বিষণ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, বাধ্যবাধকতা, মহানুভব!

 

তাহলে কখনো তা ভুলবে না, তিনি মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেলেন।

 

নিজেকে নেফারের প্রত্যাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত মনে হল। তার চোখ জ্বলছিল এবং উপরের ঠোঁটটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু টাইটার চাহনি তাকে শক্ত করল। চোখ কচলে চোখের জল মুছে নিজেকে সহজ করতে সে রথের পাশে ঝুলে থাকা পানির থলে থেকে এক চুমুক পানি খেল। তারপর বৃদ্ধ ম্যাগোস, যার লম্বা দোল খাওয়া কোঁকড়া চুলগুলো ভারি ধুলোয় একাকার হয়ে আছে, তার দিকে ফিরে আদেশের সুরে বলল, আমাকে সেই ভাস্কর্যটা দেখাও, টাটা।

 

ভগ্ন শহরটির সরু রাস্তায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ রথ, মানুষ ও এলোমেলোভাবে রাখা ঘোড়াগুলোর মধ্যকার খালি স্থানটুকু দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। ইতোমধ্যে বিশ জন সৈন্য কাপড় খুলে খালি গায়ে প্রাচীন কূপগুলোর নিচে নেমে পড়েছে; নিচের সামান্য তিতা পানি উপরে তোলার ব্যবস্থা তারা করছিল। একদা এই কূপগুলো নীল ও লোহিত সাগরের বাণিজ্য পথে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধশালী জনবহুল এলাকার লোকদের জল যোগান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তারপর, বহু শতাব্দী পূর্বে, এক ভয়ংকর ভূমিকম্প পানি ধারণের স্তরগুলো উলট-পালট করে দেয়, যার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জল তৃষ্ণায় গালালা শহর মৃত্যুবরণ করে। এখন এখানে দুশ ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ ও পানির থলেগুলো পূর্ণ করার পক্ষে খুব কমই জল অবশিষ্ট রয়েছে।

 

যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা পরিত্যক্ত চতুষ্কোণ স্থানটির মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল, টাইটা নেফারকে সরু গলিটা ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারা মন্দির ও রাজপ্রাসাদ অতিক্রম করে এগিয়ে চলল, এখন যা কেবল টিকটিকি আর বিচ্ছুদের আবাসস্থল। ঠিক মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে লর্ড ট্যানোস এবং দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে তার জয়ের প্রতীক ভাস্কর্যটি, যারা কিনা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী ও ক্ষমতাধর জাতিকে প্রায় দমিত করে ফেলেছিল। ভাস্কর্যটি একসাথে জোড়া লাগানো মানুষের খুলির এক অদ্ভুত পিরামিড যা একটা লাল পাথরের পুরু বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। পাথরে খোদাই করা স্তরগুলো যখন সে জোরে জোরে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার খুলি তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

 

আমাদের ছিন্ন মস্তকসমূহ সেই যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে যা এখানে সংগঠিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ট্যানোস লর্ড হারাব এর তলোয়ারের নিচে আমাদের মৃত্যু হয়েছিল। এ মহান লর্ডের অমর কীর্তি, যা দেবতাদের মহিমা এবং নীতিবানদের ক্ষমতা থেকে উৎসারিত–সকল প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এরূপে দেবতা ফারাও ম্যামোসের শাসনামলের চৌদ্দতম


Rx Munna

446 博客 帖子

注释