আমার মা

পাড়ার ছেলেরা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে যায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বীর মুজাহিদ নও জোয়ান

পাড়ার ছেলেরা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে যায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বীর মুজাহিদ নও জোয়ান, কবুল মোদের জান পরান, আনতে হবে পাকিস্তান, আনতে হবে পাক কোরান। মা এক্কা দোক্কা খেলা ফেলে দৌড়ে যান মিছিল দেখতে। মিছিল চলে গেলে মাও লাফিয়ে বলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কিছু না বুঝেই বলেন। হঠাৎ এক সকালে উঠে তিনি শোনেন, ভারত থেকে ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তান নামের একটি দেশ মিলেছে মুসলমানের। পাড়ার ছেলেরা নেচে নেচে মিছিলে গায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ইস্কুলে পাকিস্তানের জয়গান শেখানো হয়।

 

জীবন যেমন ছিল, পাকিস্তান হবার পর তেমনই থেকে যায় মা’র। নাসিরাবাদ মাদ্রাসায় মিয়াভাই আগেও যেমন যেতেন, এখনও যান; বাড়িতে মা’কে কোরান শরিফ পড়াতে সুলতান ওস্তাদজি আগেও যেমন আসতেন, এখনও আসেন; তফাৎটা কি হল তিনি দেখতে পান না। বাজান মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন পাঁচবেলা, এখনও যান। কেউ তো এসবে বাধা দেয়নি, তবে আল কোরান নতুন করে আনার জন্য লোক ক্ষেপেছিল কেন! মাঝখান থেকে কী হল, অমলারা কাঁদতে কাঁদতে হিন্দুস্তান চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার দিন মা কড়ইগাছ তলায় হতবাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ি ঘর জমিজমা জলের দরে বিক্রি করে চলে গেল অমলারা। মা অমলার সঙ্গে সই পেতেছিলেন। সই চলে গেলে কার না বুক খাঁ খাঁ করে! মা’রও করেছে। মা ফেরাতে পারেননি কিছু, কারও চলে যাওয়া। ইস্কুল খালি হয়ে গেল দেখতে দেখতে, কোনও হিন্দু মেয়ে আর ইস্কুলে আসে না। খালি ক্লাসঘরে দু’চারটে মুসলমান মেয়ে তখন ইতিহাস বইএর নতুন অধ্যায়ে পাকিস্তান আমাদের দেশ, কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির জনক মুখস্ত করে। ছড়া কবিতার নতুন নতুন বই আসে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার বদলে আসে গোলাম মোস্তফা, বন্দো আলী মিয়ার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের বদলে কাজী নজরুল ইসলাম। মা কিন্তু থেকে থেকেই আওড়ান আগের পড়া কবিতা। অমলার দিদির কাছে শেখা একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি মাগো দেখবে জগতবাসী অমলারা চলে যাওয়ার পরও, গান মা। যেমন জীবন, তেমনই চলে, ছোটছোট দুঃখ সুখে। পুকুরের কচুরিপানা সরিয়ে আগেও সাঁতার কাটতেন, এখনও। আগেও পিঁড়ি পেতে বসে মাছের ঝোল মেখে ভাত খেতেন, এখনও। দেশ বদলে যায়, মানুষ বদলায় কই! ইংরেজের বদলে কাবুলিঅলা হাঁটে রাস্তায়, পরদেশি বলেই ওদের ডাকেন মা। মা’র নিভৃত জগতে পুতুলগুলো আগের মত শুয়ে থাকে। কেবল মা’র পুতুলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া অমলার পুতুলটিকে বড় দুঃখী দুঃখী লাগে। মা’র বুকের জলে এক মিহি কষ্ট গোপনে সাঁতরায়।

 

পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় মা’কে। বাবার কাছে আবদার করতেন রথের মেলায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার, পুতুল কিনে দেবার। অবশ্য পুতুলের শখ মিটে যায়, যখন রক্তমাংসের একটি ছেলে জন্মায় মা’র। যে বছর ছেলে জন্মায়, সে বছরই,বায়ান্ন সন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার করার দাবি নিয়ে যারা মিছিল করছিল, তাদের গুলি ছোঁড়ে উর্দুভাষীরা। মুসলমানরে যদি মুসলমানই মারে, তাইলে আর কি দরকার আছিল মুসলমানের আলদা একটা দেশ বানানির! মা ভাবেন।

 

ছেলেরা ছয় দফার দাবি নিয়ে রাস্তায় মিছিল করে। যে রাস্তা ধরে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের মিছিল যেত, সে রাস্তায় রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুভাষী নিপাত যাক বলে মিছিল যায়। কি আশ্চর্য, মা ভাবেন, এঁদো গলির ভেতর, খলসে মাছে ভরা পুকর পাড়ে তাঁর বসে থাকতে থাকতেই মিছিলের চরিত্র পাল্টে গেল।

 

বাড়ি থেকে মনুমিয়ার দোকানে সদাই কিনতে যেতে আসতে আমাদের গলিতে লিকলিকে একটি লম্বা ছেলেকে দেখতাম প্রায়ই। পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বড়ই গাছটির তলে ছিল তার ছোট এক টিনের ঘর। পেছনে অবশ্য বড় বাড়ি। ওখানে ওর মা আর বাকি ভাই বোনেরা থাকে। তখন বাড়ির বড় হয়ে যাওয়া ছেলের জন্য বারবাড়ির ঘরটি ছেড়ে দেওয়াই নিয়ম। দাদা আর ছোটদার জন্যও তাই হয়েছিল। ছোটদা একদিন বললেন লিকলিকে ছেলেটি খোকনের বড় ভাই, মিন্টু। খোকন ছিল ছোটদার বিষম বন্ধু। এমনই, যে, প্রেমেও পড়তেন ওঁরা একসঙ্গে, এক মেয়ের। মিন্টুকে আমার বড় একা মনে হত। তাকে দেখতাম ফিনফিনে শার্ট আর নীল লুঙ্গি পরে একা একা গলিতে হাঁটতে, ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আনমনে শিস বাজাতে। এত পাকা পাকা বড়ই ঝুলে থাকত যে আমি জিভে জল নিয়ে বড়ই গাছের তলে যেতে আসতে কিছুক্ষণ দাঁড়াতাম। বড় ইচ্ছে হত পড়ে থাকা কিছু বরই কুড়িয়ে নিই। মিন্টু যদি দেখে আবার আমার কান মলে দেয়, সেই ভয়ে আমি জিভের জল জিভে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। পাড়ার ছেলেপিলেরা আমাকে দেখলে কী কই যাও? গাড়িঘোড়া দেইখ্যা হাইট্যো এরকম শাদামাটা কিছু হলেও বলত। মিন্টু আমাকে দেখত কেবল, কিছু বলত না। ও সম্ভবত খুব লাজুক ছিল। পাড়ায় থাকে, অথচ পাড়ার ছেলেদের মত ওকে দেখতে লাগে না, যেন অন্য কোনও দেশের, অন্য কোনও শহরের, অন্য কোনও পাড়ার ছেলে মিন্টু। এ পাড়ার কারও সঙ্গে তার মেলে না। সে একা নিজের সঙ্গে কথা বলে নিঝুম দুপুরে। চাঁদনি রাতে খালি গায়ে কামিনী গাছের নিচে শুয়ে থাকে একা।

 

উনসত্তরে রাজবাড়ি ইস্কুল ছাড়িয়ে আমাকে বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। বিদ্যাময়ী ইস্কুলটি শহরের মধ্যিখানে, ইস্কুলের ডানে গাঙ্গিনার পাড়, বাঁয়ে নতুন বাজার। এ ইস্কুলে আগের ইস্কুলের চেয়ে দূর। রিক্সা করে ইস্কুলে যেতে চার আনা, আসতে চার আনা, বাবা গুনে আটআনা পয়সা দিয়ে যান মা’র হাতে। মা সে পয়সা সকাল দশটা অবদি বেঁধে রাখেন আঁচলের খুঁটে। সাড়ে দশটায় আমার ইস্কুল বসে। যেতে আসতে দেখি শহর যেন উল্টে পড়ে আছে রাস্তায়। কিল ঘুসি খেয়ে শহরের চেহারা এবড়ো থেবড়ো। রাস্তায় ইটপাটকেল, গাছের গুঁড়ি। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের গাড়ি। ছোটদা প্রায়ই ইস্কুল কামাই করে মিছিলে চলে যান। আমারও ইচ্ছে করে ছোটদার মত মিছিলে যেতে। ছোটদা রাত করে বাড়ি ফেরেন, তাঁর বাড়ি না ফেরা অবদি বাবা পায়চারি করেন উঠোনে। মা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন বৈঠকঘরের দরজায়। ছোটদাকে বলা হয়েছে মিছিলে না যেতে। তিনি বাবা মা’র মোটে বাধ্য ছেলে নন, দাদা যেমন। দাদাকে ধমকে বসিয়ে রাখা যায় ঘরে, কিন্তু ছোটদাকে বাগে আনা মুশকিল, ফাঁক পেলেই তিনি পালান।

 

সেদিন চব্বিশে জানুয়ারি। সকাল থেকেই মিছিলের শব্দ শুনছি। কাকেরা পাড়ার আকাশ কালো করে চেঁচাচ্ছে। এত কাক ওড়ে কেন, মানুষই বা ছোটে কেন এত মিছিলের দিকে! মা যেমন ছিলেন রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসা খালি পায়ে, এলো চুলে, আলুথালু শাড়িতে, নখে পিঁয়াজের গন্ধ, হাতে মশলার দাগ, তেমনই দৌড়ে গেলেন গলি পেরিয়ে ঘুমটিঘরের উল্টোদিকে বড় রাস্তার ওপর মুকুলদের বাড়ি। বাড়ির খোলা বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখেন জিলা ইস্কুলের বোর্ডিং এর পাশ দিয়ে, ঠান্ডার বাপের জিলিপির দোকান পার হয়ে রেললাইনের দিকে দৌড়োচ্ছে মানুষ। মা, মুকুলের মা, শাহজাহানের মা, শফিকের মা ছুটতে থাকা পাড়ার ছেলেদের থামালেন। বারান্দায় জড়ো হতে লাগল পায়ে হাতে কাঁধে গুলি লাগা ষোল সতেরো বছর বয়সী ফারুক, রফিক, চন্দন। বাড়ির ভেতর থেকে আসতে লাগল বালতি ভরা পানি, ডেটলের শিশি, তুলো। মা’রা ছেলেদের ক্ষত মুছে দিয়ে পরনের শাড়ি ছিঁড়ে বেঁধে দিচ্ছিলেন ব্যান্ডেজ। কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দিলেন রিক্সা করে সোজা হাসপাতাল।

 

দুপুরের দিকে বাবা ফিরে এলেন। কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে তিনি ঢুকলেন মিন্টুদের বাড়িতে। বাবার পেছন পেছন মা, মা’র পেছন পেছন আমি। আমাদের পেছনে পাড়ার আরও লোক। মিন্টুর মা’র মুখের দিকে বাবা করুণ চোখে তাকিয়েছিলেন, মিন্টুর একলা পড়ে থাকা টিনের ঘরখানার দিকেও।

 

কী হইছে, মিন্টুর কিছু হইছে? মিন্টুর মা বাবার হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি খবর পেয়েছেন আগেই যে মিছিলে মিন্টু ছিল সবার সামনে, গায়ে পুলিশের গুলি লেগেছে বলে লোকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে ওকে। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন খানিক পর পর, কিছু বলছিলেন না। আমরা ছিলামই ও বাড়িতে দাঁড়িয়ে। মিন্টুর বোন, মনু, পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদছিল। মাথার ওপর ছিলই কাকের কা কা কা। পাড়ার মায়েরা মুকুলদের বারান্দা থেকে ফিরে এসে পানি ঢালছিলেন কেঁদে বেঁহুশ হয়ে পড়া মিন্টুর মা’র মাথায়। মনু থেকে থেকে মা’কে বলছিল ও ঈদুন আপা, আমার ভাইরে যারা মারছে, তাগোরে আমি খুন করুম। মনু বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিল বাড়ির বাইরে। মা তাকে ফেরাচ্ছিলেন দু’হাতে। মনু কি করে খুন করবে খুনীদের। খুনীদের হাতে বন্দুক, কেউ কি পারে খালি হাতে সশস্ত্র কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে!

 

পাড়ার লোকেরা মিন্টুর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছিল কী করে মিছিল এগোচ্ছিল পশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে, তখন বলা নেই কওয়া নেই, কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রিম দ্রিম, ছেলেরা উল্টো দিকে দৌড়োল, কেবল মিন্টু পারেনি। মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভিড় আরও বাড়ছে। খোকন, বাμচু, হুমায়ুন মিন্টুর ভাইগুলো


Rx Munna

446 ブログ 投稿

コメント