বিদ্যাময়ী ইস্কুল শহরের নামকরা মেয়েদের ইস্কুল। বিদ্যাময়ী দেবী নামে শশিকান্ত নাকি সূর্যকান্ত মহারাজার বোন ইস্কুলটি বানিয়েছিলেন। দেয়াল ঘেরা বিশাল সবুজ মাঠের ওপর লাল দোতলা দালান। বট অশ্বত্থ গাছে ছাওয়া। মাঠের একপাশে পদ্মপুকুর। ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি টিকে গেলে, ঝুনুখালা, এ ইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন যেহেতু, কোনটি কোন ক্লাসঘর, কোনটি মাস্টারদের বসার ঘর, কোনখানে এসেম্বলি হয় আমাকে চিনিয়ে বসিয়ে দেন চতুর্থ শ্রেণীকক্ষের প্রথম সারিতে। বসিয়ে, কানে কানে বলেন, মুচকি হেসে, তরে কিন্তু বড় ক্লাসের মেয়েরা আইসা একটা জিনিস কইতে পারে।
— কি কইতে পারে ঝুনুখালা?
আমার ভয় ধরা মুখে তাকিয়ে খালা হেসেছেন, রহস্য ভাঙেননি।
ঘটনা প্রথমদিন ঘটেনি, ঘটেছে দ্বিতীয়দিন। দুপুরবেলা টিফিনের একঘন্টা ছুটি হয় ইস্কুলে, টিফিন খেয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েরা মাঠে বৌচি খেলছে, দেখছি, একা দাঁড়িয়ে দেখছি, হঠাৎ চোখে পড়ে এক মেয়ে স্পষ্টতই ওপরের ক্লাসের, আমি চিনি না, রেলিংএ ভর দিয়ে আমাকে দেখছে, মুখে হাসি। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে ক্লাসঘরের দিকে দু’পা যেই বাড়াই, মেয়েটি পেছন থেকে ডাকে, এই মেয়ে শোনো।
আমি থমকে দাঁড়াই।
মেয়েটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে–তোমার নাম কি?
আমি বলি–নাম জিগাস করেন ক্যান?
লম্বা, শ্যামলা, চুল বেনি করা মেয়েটি হেসে বলে–তুমি তো খুব সুন্দর, সেজন্য।
মেয়েটি আমার হাত টেনে নেয় মুঠোয়, হাতের আঙুলে অল্প অল্প চাপ দেয়। ছাড়িয়ে নিয়ে আমি গা কাঠ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
মেয়েটি, কি নাম জানি না, বলে–ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি তোমারে কিচ্ছু করব না।
চোখ আমার মাটিতে, বুক ধুকপুক করে। মেয়েটি আরও কাছ ঘেঁসে কেউ যেন শুনতে না পায়, বলে–তুমি আমার ফেভারিট হবা?
ফেভারিট হওয়া কাকে বলে আমি জানি না। চোখ উপচে জল নামে আমার। মেয়েটি আমার চোখের জল আঙুলে মুছে দিয়ে বলে–কি বোকা মেয়ে, কাঁদো কেন!
একদল মেয়েকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখে মেয়েটি দ্রুত সরে যায়।
ক্লাসঘরের সিলিং জুড়ে লম্বা রঙিন কাপড়ের পাখা, ঘরের বাইরে বসে আয়ারা টানে, পাখা দোলে, ওই টানা পাখার নিচে বসেও ভেতরে ঘামতে থাকি ভেবে যে একটি ওপরের ক্লাসের মেয়ে নিশ্চয় আমাকে ফুঁসলিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কোথায় কে জানে!
মেয়েটি পরদিন টিফিনের সময়, সেদিনও আমি সিঁড়ির কাছে একা দাঁড়িয়ে, হাতে একটি পাকা পেয়ারা দিয়ে বলল–এই লাজুক মেয়ে, ফেভারিট হবা না আমার? বল, হবা। আমি তোমারে অনেক অনেক আদর করব।
বুজে আসা স্বরে বলি–না।
মেয়েটি মিষ্টি হেসে আমার হাত ধরে, আমি মুঠি করে রাখি হাত।
ক্লাসের কিছু মেয়ে, আমি তাদের নামও তখন জানি না, ইস্কুল ছুটির পর গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে–তোমার ফেভারিট কে? ওইযে লম্বা আপাটা তোমার ফেভারিট, না?
আমি কিছু বুঝে পাই না ফেভারিট ব্যাপারটি কি! মেয়েরা কার ফেভারিট কে, এই নিয়ে কানাকানি করে। কেউ তার ফেভারিটের নাম বলে না, সব যেন বড় গোপন এক ব্যাপার।
ঝুনু খালার কাছে গোটা ব্যাপারটি পরে জানা হয় আমার। বিদ্যাময়ী ইস্কুলে এ খুব পুরোনো নিয়ম যে ওপরের ক্লাসের মেয়েরা নিচের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ফেভারিট পাতে। একধরনের সই পাতার মত। ঘটনাটি আর সবার কাছে গোপন থাকা চাই। কেউ যেন না দেখে তারা ইস্কুল ছুটির পর নয়ত খেলার ঘন্টায়, নয়ত টিফিনের সময় গাছের তলে, পুকুরঘাটে, দেয়ালের আড়ালে দেখা করে, হাতে হাত রেখে গল্প করে, বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে এটা ওটা উপহার দেয়। ঝুনু খালার ফেভারিটের নাম ছিল বিউটি। অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে। ঝুনুখালা যখন বিউটির কথা বলেন, মিষ্টি হাসেন, সেরকম মিষ্টি হাসি লম্বা মেয়েটিও হেসেছিল।
দিন যেতে থাকে, আর আমার মনে হতে থাকে ফেভারিট ব্যাপারটি বিষম এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। ইচ্ছে করে আবার কেউ এসে একবার ফেভারিট হতে বলুক আমাকে। একবার কেউ ডাকলেই আমি চলে যাব, চলে যাব সুতোর ওপারে। ক্লাসের সুন্দর মেয়েগুলো টিফিনের ঘন্টা পড়লে পাখির মত উড়াল দিয়ে কোথায় যে যায়! কান পাতলে মেয়েদের কানাকানি শুনি যে মমতার গলার নতুন মালাটি ওর ফেভারিট দিয়েছে। শাহানার ফেভারিটের নাম বন্যা। কেউ বলে বন্যা নয়, কেউ বলে না বন্যাই, বন্যার সঙ্গে বট গাছের আড়ালে কেউ ওকে ঘনিষ্ট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।
আমি এক বোকাচন্দ, লজ্জাবতী লতা। ফেভারিট নেই, ক্লাসেও কোনও বন্ধু নেই, কেউ আমাকে খেলায় নেয় না, ক্লাসে পড়া ধরলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। গানের, নাচের, খেলার ক্লাসেও আমার মত লাড্ডু আর একজনও নেই। বাংলা ক্লাসে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল–একটা ফুলের নাম বল তো দেখি! আমি ভাবছিলাম, ফুল তো অনেকই আছে, কিন্তু খুব সুগন্ধ ছড়ায় কোন ফুল, গোলাপ না কি দোলন চাঁপা নাকি শিউলি নাকি বেলি, নাকি রজনীগন্ধা।
মাস্টার আমার নৈঃশব্দ্য দেখে রাগ করে বললেন–মেয়েটা কি বোবা নাকি!
বোবাই। বোবা বলে, সে, যেহেতু ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলতে হবে মাস্টারকে মে আই গো টু দ্য বাথরুম? এরকমই বলার নিয়ম, ইংরেজিতে, আর মাস্টার ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, হ্যাঁ অথবা না, না বললে বসে থাকতে হবে শ্বাস বন্ধ করে, যা যে কেউ দেখলেই বুঝবে কেন, আর হ্যাঁ বললে সবার চোখের সামনে দিয়ে আমাকে দৌড়ে নয়ত ঠ্যাং চেপে হাঁটতে হবে–সকলে ভাবতে বসবে আমি বড়টির জন্য যাচ্ছি নাকি ছোটটির জন্য, এসব জিনিস যে জনসমক্ষে চাপা বড় লজ্জা, তাই আমি মে আই গো টু জাতীয় কোনও বাক্যে না গিয়ে বোবা হয়ে ছিলাম। শক্তি দিয়ে ঠেকাচ্ছিলাম। ঠেকিয়েছিলাম, মাস্টার চলে গেলে, কেউ যেন না বোঝে কোথায় যাচ্ছি, গিয়ে মাঠের যে কোণাটিতে পায়খানা, সে কোণায় ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠেকিয়ে। পরে আসা মেয়েগুলো আমাকে ডিঙিয়ে এক এক করে সেরে আসে। আমার আর সারা হয় না। বেগবান জিনিস শরীর থেকে বেরোতে হাত পা ছুঁড়ে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হওয়া নিরস্ত্র হওয়া আমার সঙ্গে। মনে মনে বলি আর একটু সবুর কর বাবা। সবুর কার এত সয়! শেষ অবদি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে যোদ্ধার দল। শাদা পাজামা মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি লজ্জায় মুখ নিচু করে, দেয়ালে শরীর সেটে, একা। আমি জানি না কে আমাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। উদ্ধার করতে অবশ্য একজন এগিয়ে আসে, যে মেয়েটি আমার সামনে এসে মিষ্টি হেসে বলে কি হয়েছে, এখানে একা একা দাড়ায়া আছ কেন? সে ওই লম্বা মেয়েটি, চোখের জল মুছে দেওয়ার, পাকা পেয়ারার। ধরণী আসলে দ্বিধা হয় না কখনও, যত তাকে হতে বলা হোক না কেন। অথবা হয়, সীতা হলেই হয়, আমি কি আর সীতা হতে পেরেছি! আমার মাথা ঘাড় থেকে ঝুলে থাকে, যেন এক্ষুণি ছিঁড়ে পড়বে, মেয়েটি বুঝে আমার করুণ দশা, হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে আমার বই খাতা ক্লাস থেকে নিজেই নিয়ে এসে ইস্কুলের মেথরানি রামরতিয়াকে সঙ্গে দেয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। এ কাজটি যদি অন্য কেউ করত, সইত।
বাড়িতে খবরটি গোপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। সম্ভব হয়নি। অসময়ে ইস্কুল থেকে হলুদ পাজামার ফেরা, সঙ্গে মেথরানি। বাড়ির বড়রা মুখ টিপে হাসে, ছোটরা গলা ফাটিয়ে। দাদার নিজের একার দুর্নাম ঘুচল এবার, সাত পাক নেচে বলে–
বিদ্যাময়ীর হাগড়া গাড়ি শাদা পাজামা হলুদ করল
অসময়ে ইস্কুল থেইকা রামরতিয়ায় নিয়া আইল।
পুরো মাস আমাকে গুয়ের চারি, রামরতিয়ার সই বলে ডাকা হল বাড়িতে। মা অবশ্য মাঝে মধ্যে ধমকে সরান দাদাকে, বলেন ওর পেটটা খারাপ আছিল।
মা’র আস্কারা পেয়ে আমি দাদাকে ভেংচি কেটে বলি–তুমিও তো ইস্কুলে হাগ্যা দিতা!
দাদা বলে–ইহিরি, তর মত বড় হইয়া হাগছি নাকি, আমি তহন ছোট্ট, ওয়ানে পড়ি মাত্র।
দাদাকে নিতে এক্সপেরিমেন্টাল ইস্কুলের রিক্সা আসত, বাচ্চারা যেন সিট থেকে পড়ে না যায় সামনে বেল্ট বাঁধা থাকত। প্রায়ই ইস্কুল ছুটির আগেই দাদাকে বাড়ি দিয়ে যেত রিক্সাঅলা। দু’আঙুলে ধরা থাকত দাদার গুয়ে মাখা হাফপ্যান্ট। একদিন রেগেমেগে রিক্সাঅলা বলল ছেলের পেট ভালা কইরা পরে ইস্কুলে পাঠাইয়েন।
মা বলেন–একবার এক কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরে নোমানের পেট যে খারাপ হইল তো হইলই। আইজও ওর পেটটা ভালা না।
এটি হচ্ছে দাদার জন্মের দোষে নাকি কৌটোর দুধের দোষে, মা নিশ্চিত নন।
দাদার হেগে দেওয়া প্রসঙ্গ এলে আমি স্বস্তি বোধ করি। অন্তত আমি যে একা একটি বিশ্রি কান্ড ঘটাইনি, তা ভেবে। কিন্তু ইস্কুলে সে স্বস্তি জোটে না আমার।
ইস্কুলে কারও ফেভারিট হওয়ার সম্ভাবনা, আমি বুঝি, আমার আর নেই। লম্বা মেয়েটিকে দূর থেকে দেখেই উল্টো হাঁটি। যে কেউ আমার দিকে তাকালে মনে হয় সে বুঝি আমার পাজামা হলুদ করার ঘটনাটি জানে। লজ্জায় আমার কান নাক লাল হয়ে থাকে।
যুদ্ধ শেষ হলে যখন ইস্কুল খোলে, বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের ওপরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। পাক সর জমিনের বদলে ইস্কুলের এসেম্বলিতে নতুন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে গাইতে হয় আমার সোনার বাংলা। মানুষের দৈর্ঘ প্রস্থ বদলে গেছে, ভাবনা ভাষা আরও সতেজ, দীপ্ত, আরও প্রাণময়। যেন বয়স ন’ মাসের বদলে বেড়ে গেছে ন’ বছর। যেন বালিকারা এখন আর বালিকা নয়, তরুণী। কারও বাড়ি পুড়েছে, কারও ভাই হারিয়েছে, কারও বাবা, কারও ধর্ষিতা বোনের জরায়ুতে ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে অনাকাংখিত শিশু। এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সকলে আমরা হেঁটে এসেছি, লাশ দেখতে দেখতে, আর্ত চিৎকার শুনতে শুনতে।
তখন কোনও এক বালিকা-বেলায় শাদা পাজামা হলুদ করে বাড়ি ফিরেছিলাম এ নিতান্তই বিস্মৃত হওয়ার মত তুচ্ছ।
অপেনটো বায়োস্কোপ
নাইন টেন তেইসকোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
বলে মেয়েদের গলায় মালা পরিয়ে নিজের দলে নিয়ে গোলাপ পদ্ম খেলতে, আমার আর কান গরম হয় না শরমে। খেলার ঘন্টা বাজলে জিমনেসিয়ামে