উতল হাওয়া

কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহের নতুন ইশকুলে ভর্তি হয়ে যেদিন প্রথম এল ও ক্লাস করতে, সেদিনই ওর

কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহের নতুন ইশকুলে ভর্তি হয়ে যেদিন প্রথম এল ও ক্লাস করতে, সেদিনই ওর সঙ্গে আমার কথা হল, চোখে চোখে। ওর প্রায় বুজে থাকা চোখ দুটো একই সঙ্গে এত কথা বলল সেই প্রথম দিনই, প্রথম দিন ও অবশ্য ওর মামাতো নাকি কাকাতো নাকি ফুপাতো বোন সীমা দেওয়ানের গা ঘেঁসে ছিল, দ্বিতীয় দিনও তাই, আমার বেঞ্চে বসল তৃতীয় দিন আর ওদিনের পর আমার বেঞ্চ ছাড়া কারও বেঞ্চে ও বসেনি। চন্দনার গায়ের রং না-লেখা কাগজের মত শাদা, নাক যেন ইটে থেতলে দেওয়া হয়েছে এমন, আধেক চোখ আড়াল করা চোখের পাতায়, বাকি আধেকের দ্যুতি আমারই অলক্ষ্যে আমার হৃদয় আলোকিত করে। ওর বিনুনিবিহীন দীঘল ঘন চুল বন্ধন মুক্ত হলেই পিঠে বর্ষার জলের মত উপচে পড়ে আর আশরীর ভিজে গোপনে গোপনে স্নিগ্ধ হতে থাকি আমি। দিলরুবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার পাশের জায়গাটি কারও জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, আমার বুঝে ওঠার আগেই চন্দনা আমার পাশে নির্দিষ্ট হয়ে গেল। প্রতিদিন চন্দনার শব্দ গন্ধ বণর্ আর প্রতিদিনই দিলরুবার না থাকা দুটোই আমার পাশে বসে থাকে আমারই ছায়ার মত। কেবল চন্দনাই তখন ক্লাসে নতুন ভর্তি হওয়া মেয়ে ছিল না, বিদ্যাময়ী থেকে দলে দলে মেয়ে আসছে, আমার সেই যুদ্ধংদেহি বন্ধুরাই। কিন্তু কেউ আমার কপালের চন্দন-তিলকে একতিল কালি ছোঁয়াতে পারেনি। একটি তরঙ্গও তুলতে পারেনি সেই চন্দন-সুবাসে, যেখানে অহর্নিশি আমার আকণ্ঠ অবগাহন।

 

শহরের এক কোণে নির্জন এলাকায় আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তন দাঁড়িয়ে আছে বটে, গুটিকয় হাতে গোনা মেয়ে আছে বটে এখানে, কিন্তু মেট্রিকে বিদ্যাময়ীর মেয়েদের চেয়ে ভাল ফল করেছে এই ইশকুলের মেয়েরা, কেবল তাই নয় গড়ে প্রথম বিভাগ বেশি জুটেছে অন্য যে কোনও মেয়েদের ইশকুলের চেয়ে এই ইশকুলে, তাই ঘাড় ধরে আমার বাবা যেমন ঠেলে দিয়েছিলেন যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে সবে পা দিয়েছি, অন্যদের বাবাও সপ্তম অষ্টমে যদি সম্ভব না হয়েছে, নবম দশমে পড়া কন্যাদের একই রকম করে এই ইশকুলে ঠেলেছেন। নির্জনতা এই ইশকুলের অনেকটাই তখন কেটেছে। সবচেয়ে বড় শ্রেণীর ছাত্রী বলে তখন বিষম এক আনন্দ হয়। বই খাতার মলাটের ওপর মোটা কলমে নিজের নাম যত না বড় করে লিখি, তার চেয়ে বড় করে লিখি দশম শ্রেণী।

 

চন্দনার উতল হাওয়ায় উড়ছি যখন, সামনে বিকট দজ্জালের মত রাম দা হাতে মেট্রিক পরীক্ষা, চৌকাঠ পেরিয়ে প্রায় অন্দরমহলে ঢুকছে এমন, বাড়িতে বাবা মুহুর্মুহু উপদেশ বষর্ণ করছেন যেন মুখস্থ ঠোঁটস্থ এবং অনঃ্ত স্থ করে ফেলি সবকটি বইএর সবকটি পৃষ্ঠার সবকটি অক্ষর। কালো কালো অক্ষর ছাড়া আমার জগত জুড়ে আর কিছু যেন না থাকে। বাবার উপদেশ পালন করার ইচ্ছে বাবা বাড়ি থেকে বেরোলে বা তাঁর নাক ডাকার শব্দ শুনলেই উবে যায় আমার। ইশকুলে যাবার পথে এক ক্লাস ওপরে পড়া এডওয়ার্ড ইশকুলের ছেলেগুলো ইস্ত্রি করা জামা গায়ে, চোখের কোণে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি নিয়ে ত্রিভঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে সারাদিন আমার মনে লাল নীল সবুজ হলুদ যত রকম রং আছে জগতে, লেগে থাকে। ইশকুলে পৌঁছে পড়ালেখার চেয়ে বেশি সেঁটে থাকি নাটকঘর লেন থেকে হেঁটে আসা মাহবুবার কাছে খবর নিতে ছেলেগুলোর নাম, কে কোন পাড়ায় থাকে, কার মনে কী খেলে এসব। মাহবুবা তার ভাইদের কাছ থেকে যে তথ্য পায় তাই পাচার করে, যে তথ্য পায়নি তাও অনুমান করে বলে। চন্দনা মুঠো খুলতেই আষাঢ়ে বৃষ্টির মত ঝরে প্রেমের চিঠি, দিনে ও চার পাঁচটে করে চিঠি পেতে শুরু করেছে। পাবে না কেন! পণ্ডিতপাড়ার আঠারো থেকে আঠাশ বছর বয়সের ছেলেরা অনিদ্রা রোগে ভগু ছে ওকে দেখে অবদি। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে মমতা বানুকে নিয়ে প্রতিদিন গুঞ্জন, বাঘমারা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ইমতিয়াজ তরফদার নাকি মমতার প্রেমের জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে বসেছিল। কারও সাতে নেই পাঁচে নেই নাক উঁচু বুক উঁচু ভাল ছাত্রী আসমা আহমেদেরও জিলা ইশকুলের কোনও এক ভাল ছাত্রর সঙ্গে নাকি কোথায় দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। সারার দিকে ইশকুল ঘেঁসা বাড়ির ছেলে জাহাঙ্গীর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সারার নাকি ছেলেটিকে মন্দ লাগে না। পপির সঙ্গে নাদিরা ক্লাসের ফাঁকে ফিসফিস কথা বলে, আশরাফুনন্নেসা নামের ঠোঁটকাটা মেয়ে তাই দেখে অনুমান করে পপির ভাই বাকির প্রেমে পড়েছে নাদিরা। শিক্ষক শিক্ষিকা কে কার ঘরে উঁকি দিলেন, কার কথায় কে হেসে গড়িয়ে পড়লেন, কার চোখের তারায় কার জন্য কী ছিল—টুকরো টুকরো গল্প বাতাসের পাখা মেলে আমাদের কানেও পৌঁছোয়। চন্দনা এসব উড়ো খবর নিয়ে মাতে, আমিও। ও আবার নিজের দু-একটি খুচরো প্রেম নিয়েও থাকে মেতে। ক্লাসে বসেই পাতার পর পাতা প্রেমের পদ্য লিখে ফেলে হয়ত কারও উদাস দুচোখের কথা মনে করে, সেদিন সকালেই দেখা কারও চোখ। রাস্তায় দেখা লৎু ফর নামের চশমা চোখের ছেলেটির জন্য আমারও কেমন কেমন যেন লাগে। ইশকুলে যেতে আসতে ছুঁড়ে দেয়া ওর দুটো তিনটে চিরকুট পেয়ে রাতের ঘুম উবে যায়। চোখ যে মনের কথা বলে ইতি লৎু ফর লেখা একটি চিরকুট আমার পদার্থবিজ্ঞান বইএর ভেতর থেকে পড়বি পড় মালির ঘাড়ে না হয়ে বাবার পায়ের কাছে উড়ে গিয়ে যেদিন পড়ল, বাবা পরদিন থেকে আমার ইশকুল যাতায়াতে পাহারা বসালেন, বড়দাদার দায়িত্ব পড়ল আমাকে সকাল বেলায় ইশকুলে দিয়ে যাওয়ার আর ছুটির পর বাড়ি ফেরত নিয়ে যাওয়ার। ছুটি হলে ইশকুলের গেটের কাছ থেকে মেয়েরা রিক্সা নিয়ে বাড়ি চলে যায়, কেউ যায় হেঁটে, দএু কজনকে নেবার জন্য পিঠকুঁজো ফক্সওয়াগন গাড়ি আসে, সব চলে গেলে এমনকি মমতা বানুও(ওকে দিতে এবং নিতে চিরকালই ওর রণরঙ্গিণী মা আসেন), আমার দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যতক্ষণ না লম্বা শাদা দাড়ি মুখে সবুজ লুঙ্গি পরে কালো রাবারের জুতো পায়ে বুড়ো দাদা উদয় হচ্ছেন। ইশকুল ছুটির পর গেটের কাছে ওভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকাও অশান্তির, আর যদি বড়দাদা আগেভাগেই উপস্থিত হন তবে সবার চোখের সামনে তাঁর সঙ্গে রিক্সায় উঠতে গিয়েও আমার অস্বস্তির শেষ থাকে না কারণ তখন আমি নিশ্চিত বড়দাদার মাথার টুপি মুখের দাড়ি রাবারের জুতো পরনের লুঙ্গির দিকে তাকিয়ে সকলেই ঠোঁট টিপে হাসছে আর মনে মনে অনুমান করছে কত বড় গেঁয়ো ভুতের বংশের মেয়ে আমি। আমার সাধ্য বা সাহস কোনওটাই নেই মিথ্যেচার করার যে দাড়িঅলা লোকটি আদপেই আমার কেউ হয় না। তিনি যে বড়ই নিকটাত্মীয়, সে কথাও মখু ফুটে কাউকে বলা হয় না। অনেকদিন চিরকূটের গন্ধ না পেয়ে পাহারা তুলে দেন বাবা। পাহারা তুলতে হয় বড়দাদার শস্যভরা ক্ষেত গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধানের টানে, আপন কুঁড়েঘরে, মাদারিনগর গ্রামে ফেরার সময় হয় বলেও। গ্রাম ছেড়ে শহরে দীর্ঘদিন কাটালে বড়দাদার মাথায় গোলমাল শুরু হয়। প্রতিদিনই তাঁর জায়নামাজ হাতে নিয়ে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতেই হয় পশ্চিম কোন দিকে। আমাকে যতবারই তিনি জিজ্ঞেস করেছেন আমি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব সব দিককেই পশ্চিম বলে দেখিয়ে দিয়েছি কেবল পশ্চিম দিক ছাড়া আর তিনি দিব্যি জায়নামাজ পেতে সেদিকে ফিরেই দু হাতের দু বুড়ো আঙুলে দু কানের দুলতি ছুঁয়ে আল্লাহু আকবর বলে নামাজ শুরু করেছেন।

 

বড়দাদা সঙ্গে থাকলে তাঁর আপাদমস্তকের লজ্জায় আমাকে ঘাড় নুয়ে বসে থাকতে হত, সেই ঘাড় সোজা করার সুযোগ হল, রিক্সায় বসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দিকেও লুকিয়ে তাকানোর। লুৎফরের সঙ্গে নীল প্যান্ট শাদা শার্ট পরা নতুন একটি নাদুসনুদুস ছেলেকে দেখে ছেলেটির জন্যও হঠাৎ একদিন মন কেমন করতে লাগল। এক পলকের দেখাতেই মন কেমন করে, প্রেমের অতল জলে ডুবে মরছি বলে মনে হতে থাকে, মনে হতে থাকে বাড়ি ফিরে নাদুসনুদুস আমার কথা ভাবছে, পরদিন সকাল দশটায় ইশকুলে যাবার পথে আমাকে এক পলক দেখবে বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে সে। রাস্তায় দাঁড়ায় সে পরদিন, দেখে মনে হয় পৃথিবীতে এই নাদুসনুদুসের চেয়ে সুদর্শন আর কেউ নেই, মনে হয় কি আশ্চর্য ভাবে আমার পুরোটা জীবনই নাদুসনুদুসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, মনে হতে থাকে ওর ঠোঁটের হাসি চোখের হাসি প্রতিদিন না দেখতে পেলে আমার এই জীবনটিই ব্যথর্। এসব এক পলকের প্রেম থেকে, যেগুলোকে মনে হত না হলে নির্ঘাত মারা পড়ব, একদিন হঠাৎই মন অন্যদিকে ফেরে, সে লাইব্রেরির বইয়ে। যত বই আছে তাকে, নিমেষে পড়ে ফেলার আকুলতা হাঁমুখো হাঙরের মত এগোয়। নাগালের বইগুলো পড়া হয়ে গেলে নাগালের বাইরের বই পায়ের আঙুলে ভর করে দাঁড়িয়ে বা মই বেয়ে উঠে ওপরের তাক থেকে পেড়ে এনে আমি আর চন্দনা গোগ্রাসে পড়ি; বাড়িতে পাঠ্য বইয়ের তলে, বালিশের তলে, তোশকের তলে সেসব বই অথচ পরীক্ষা সামনে। গৃহশিক্ষক শামসুল হুদা পদার্থবিজ্ঞান রসায়নবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান অঙ্কবিজ্ঞান ইত্যাদি সাত রকম বিজ্ঞান যখন পড়ান, প্রায় বিকেলেই তাঁর চড় থাপড় খাওয়া আমার নৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। তা হোক, শামসুল হুদা আমাকে বিজ্ঞান-জ্ঞান বিতরণ করে চা বিস্কুট খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই আবার সেই তোশকের বালিশের তলের অপাঠ্যে ঝুঁকে পড়ি। আমার চেয়ে চার কাঠি এগিয়ে থাকে চন্দনা। বই আমি দুটি শেষ করলে ও করে সাতটি। ওর সঙ্গে বইপড়া-দৌড়ে আমি বরাবরই পেছনে। বইপোকা মমতাও চন্দনার সঙ্গে পেড়ে উঠত না, আমার বিশ্বাস। লাইব্রেরির বইগুলোকে ইশকুলের মেয়েরা বলে আউটবই। আউটবই শব্দটির মানে কি, একবার জানতে চেয়েছিলাম, উত্তর ছিল সিলেবাসের বাইরে যে বই, সে বই আউটবই। আউটবই পড়া মেয়েদের শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ভাল ছাত্রীরা খুব ভাল চোখে দেখে না। আউটবই যারা পড়ে, তারা ক্লাসের পড়ায় মন দেয় না, মন তাদের থাকে উড়ু উড়ু মোদ্দা কথা তারা মেয়ে ভাল নয়, পরীক্ষায় গোল্লা জাতীয় জিনিস পায়, এরকম একটি ধারণাই চালু ইশকুলে। এই ধারণাটি কেন, তা আমার বোঝা হয় না। আমি আউটবই পড়েও পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারি, তা প্রমাণ করার পরও ধারণাটি ঘোচে না। ওই পড়ার নেশাতে অন্যরকম একটি জগত তৈরি হয় আমার আর চন্দনার। শিক্ষক শিক্ষিকার বা ক্লাসের মেয়েদের ব্যক্তিগত কোনও প্রেম বিরহের খবর বাতাসের সঙ্গে বা বাতাসের আগে আমাদের কানে আসে না, মাঝপথে কোথাও থমকে থাকে। আমাদের বাতাস তখন ভারি পার্বতীর কান্নায়, রাজলক্ষ্মীর নগ্ন পদধ্বনিতে, চারুলতার নিঃসঙ্গতায়, বিমলার দ্বিধায়।

 

বাতাস যে সবসময় ভারি হয়েই থাকে তা নয়, মাঝে মধ্যে অমল হাসিতে আবার অমলিন হয়ে ওঠে, আবার ফুরফুরে। আমাদের লাইব্রেরিয়ান সাইদুজ্জামানের ঠোঁটে তেমন একটি অমল হাসি খেলে প্রায়ই। মাঝে মাঝে আমাদের ইসলামিয়াত পড়ান তিনি, এই একটি বিষয়ের জন্য ইশকুলে কোনও শিক্ষক নেই, যে শিক্ষকের যখনই অবসর থাকে, ইসলামিয়াত পড়াতে ক্লাসে আসেন। ইসলামিয়াত ক্লাসে সাইদুজ্জামানের হাসি নিখাদ আকর্ণবিস্তৃত। তাঁর হাসির মূল্য


Rx Munna

446 Blog postovi

Komentari

📲 Download our app for a better experience!