ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনে সপ্তম শ্রেনী থেকে প্রতিটি শ্রেণীতেই বৃত্তি পেয়েছি আমি, সে বৃত্তির একটি

আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনে সপ্তম শ্রেনী থেকে প্রতিটি শ্রেণীতেই বৃত্তি পেয়েছি আমি, সে বৃত্তির একটি টাকাও কোনওদিন নিজের জন্য রাখতে দেননি বাবা, গুনে গুনে তুলে নিয়ে গেছেন। মা বলেছেন, তর বাবা তর ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতাছে টাকা। তুই বড় হইলে দিব। মার কথা বিশ্বাস হত আমার। বাবার হাতে চলে যাওয়া টাকাকে নিজের টাকা ভেবে একধরণের স্বস্তি হত। বড় হয়ে ওই টাকায় ঘর বোঝাই বই কেনার স্বপ্ন দেখতাম। ইয়াসমিন পঞ্চম শ্রেণীতে দুবার থেকে একটি কাণ্ড ঘটিয়েছে, ওকে ইশকুল বোর্ডের বৃত্তি পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন বাবা, পরীক্ষায় ভাল করে ও দিব্যি বৃত্তি পেয়ে গেছে। এখন ইয়াসমিনকে ডাকতে হলে বাবা বলেন, কই বৃত্তিধারী ছাত্রী কই! পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা আমার দেওয়া হয় নি, অষ্টম শ্রেণীরটি দেওয়া হলেও কপালে কিছু জোটেনি। কপালে কিছু জোটেনি বলেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইয়াসমিনকে বৃত্তিধারী ছাত্রী বলে ডাকেন বাবা। কেবল তাই নয়, বাবা আমাকে নর্দমার কীটের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক। শুনে নিজেকে অনেকবারই সত্যিইনর্দমার কীট বলে মনে হয়েছে। তারকাখচিত প্রথম বিভাগ জোটেনি বলেও আবার নিজেকে নর্দমার কীট বলে মনে হতে থাকে। চন্দনা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। এ নিয়ে তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। দ্বিতীয় বিভাগেই পাশ করেছে বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী। দ্বিতীয় বিভাগ যদি আমার জুটত, তবে বাবা চাবকে আমাকে রক্তাক্ত করে বাড়ি থেকে সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দিতেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে স্বস্তি জোটে, প্রথম বিভাগ পাওয়ার ফলে কলেজে বৃত্তি পাব, বিনে পয়সায় কলেজে পড়ব, বাবা বৃত্তি জিনিসটি খুব পছন্দ করেন, খানিকটা হলেও ভারমুক্ত হই। অন্তত এ ব্যাপারটি না ঘটলে উঠতে বসতে বাবার দাঁত খিঁচোনো দেখতে হত। এখনও যে হয় না তা নয়। আমি নিশ্চিত, বৃত্তি না জুটলে আরও হত।

 

কলেজে ভর্তি হতে কোনও পরীক্ষার দরকার হয়নি। মেট্রিকের ফল দেখেই ভর্তি করে নিয়েছে কলেজে। খামোকা আমাকে মেট্রিক পরীক্ষার পরও সেই ইশকুলের বইগুলো পড়তে হয়েছে, ভেবে আফসোস হয়। সময়গুলো অযথা উড়ে গেছে, হাওয়ায় উড়েছে। আর কি কখনও ফিরে আসবে অমন অবসর!সময় হয়ত অনেক আসবে, মেট্রিকের পরের সময় আর আসবে না।

 

আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, ও কলেজে আবার ছেলেরাও পড়ে, ছেলেদের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে ক্লাস করতে দিতে আর যিনিই দিন না কেন, বাবা দেবেন না। ঘাড় ধরে, আনন্দমোহনের ভাল কলেজ হিসেবে নাম থাকলেও, মুমিনুন্নিসার কোনও নাম না থাক, যেহেতু এটি মেয়েদের কলেজ, এটিতে আমাকে ঢুকিয়ে, অনেকটা হাঁসের খোঁয়াড়ে যাবার বায়না নাকচ করে দিয়ে মুরগিকে আর দশটা মুরগির সঙ্গে এক খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার মত, স্বস্তি পেলেন তিনি। যতটা অখুশি হওয়ার দরকার ছিল এ কলেজে এসে, ততটা হইনা, এর কারণ চন্দনা। ওর বাবাও ওকে ধরে বেঁধে মুমিনুন্নিসা কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। চন্দনাকে পেয়ে প্রতিদিন একশ ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য কপাল চাপড়ানো তো দূরের কথা, মন কালো করে যে দুদণ্ড একলা বসে থাকব, তা হয়না। আনন্দমোহন আমাদের কাছে আকাশপারের কোনও রহস্যময় সপ্তম স্বর্গ হয়ে রইল, ওটিকে আপাতত মাচায় তুলে রেখে আরও আরও স্বপ্ন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি আর চন্দনা। মুমিনুন্নিসা কলেজটি শহরের পশ্চিম কোণে বিশাল এক মাঠের ওপর। ক্লাস হয় একটি লম্বা টিনের ঘরে, গঞ্জের ইশকুলঘরের মত ঘরটি। আরেকদিকে নতুন ওঠা দালানঘর। এই দালানঘরে বিজ্ঞানের ছাত্রীদের বেশির ভাগ ক্লাস হয়। ইশকুলের মত এক ঘরেই সমস্ত ক্লাস নয়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে যেতে হয় বিভিন্ন ক্লাসে। এই নিয়মটি আমার পছন্দ হয়। ইশকুলে সেই সকালে একটি ঘরের একটি বেঞ্চে বসা হল তো সারাদিন ওখানেই বসে থাকতে হয়। কলেজের আরও একটি নিয়ম আমার ভাল লাগে। তুমি যদি কোনও ক্লাসে না যাও, মাঠে বসে থাকো বা পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে গপ্প কর, কেউ তোমার চুলের মুঠি ধরে নিয়ে বসিয়ে দেবে না ক্লাসে, এক ক্লাস মেয়ের সামনে কান ধরে এক ঠ্যাংএ দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে না। ক্লাসে ক্লাসে নাম ডাকা হচ্ছে। ইশকুলের মত এক ক্লাসে নাম ডাকা হল তো সে নিয়ে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবদি থাকা নয়। কলেজের নতুন নিয়মে চমৎকৃত হই, কিন্তু কলেজ থেকে যখন ইচ্ছে তখন বেরোতে পারব না, এ নিয়মটি আমার মোটেও ভাল লাগে না। চন্দনার তো লাগেই না। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ও অনেকবার বলেছে, কলেজে পড়ার মজা কি জানস? ইচ্ছা হইলে ক্লাস করবি, ইচ্ছা না হইলে করবি না। যখন ইচ্ছা কলেজ থেইকা বাইর হইয়া পড়া যাইব। ঠিক কলেজ ছুটির টাইমে বাড়িতে আইয়া পড়লেই হইল। এই স্বপ্ন আমাকে বিভোর কম করেনি। কিন্তু কলেজে যেতে শুরু করে ছফুট লম্বা সাপের মত কালো মিশমিশে শরীরের চুলহীন দাঁতহীন গগনকে দেখে আমার পিলে চমকে ওঠে। কি রে বাবা, দারোয়ান কেন? ইশকুলের গেটে দারোয়ান থাকে। ইশকুলের বাচ্চাদের জন্য। কলেজে পড়া বড় মেয়েদের জন্য, যারা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে, তাদের জন্য পাহারা বসানোর তো কোনও যুক্তি নেই! চন্দনা একমত। সকাল দশটায় কলেজে এসেছি। দুটো ঘন্টা কোনও ক্লাস নেই। চন্দনা বলে চল বাইরে যাই। বাইরে কোথায় তার কোনও সিদ্ধান্ত নিই না। বাইরে। এই সীমানার বাইরে। বাড়ির সীমানার বাইরে যেতে যেমন উতলা হই, এই কলেজ সীমানার বাইরে যেতেও। কিন্তু চল বললেই কি যাওয়া হয়, গেটের দিকে যেতে নিলেই গগন আমাদের খপ করে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, দুঘন্টা আমাদের করার কিছু নেই। না থাক। তবু গেটের বাইরে এক পা ও ফেলা যাবে না। যাবে না তো যাবেই না। গগনকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি, আমরা আর ছোট নেই, বড় হয়েছি. আমরা হারিয়ে যাব না, বা কোনও ছেলেধরা আমাদের বস্তায় পুরে কোথাও নিয়েও যাবে না। গগনে তবু গনগনে আগুন, কোনও মেঘবৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। গগন আমাদের স্বপ্নের লেজ ধরে ছুঁড়ে দেয় দূরের নর্দমায়। মেয়েদের কলেজের নিয়ম হচ্ছে, একবার ঢুকে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, সেই বিকেলে ছুটির ঘন্টা পড়বে তো বেরোতে পারবে। ইশকুলের দশটা পাঁচটা নিয়মের মধ্যে এত বছর বন্দি থাকার পর কলেজে এসে যদি পাখা না মেলতে পারি, তবে আর কলেজে আসা কেন! আনন্দমোহন কলেজে ছেলেমেয়েরা যখন খুশি ঢোকে, যখন খুশি বেরোয়। আর মুমিনুন্নিসার মেয়েরা, যেহেতু এরা মেয়ে, এরা বড় হয়ে গেলেও এদের বড় বলে জ্ঞান করা হয়না, তাই আবারও দশটা পাঁচটার হিশেব, আবারও ইউনিফমর্, শাদা পাজামা, শাদা জামা, লাল ওড়না। ইশকুল ছেড়ে কলেজে নাম লিখিয়েছি, দালান পালটেছে, মাস্টার পালটেছে, বইপত্র পালটেছে কিন্তু নিয়ম ওই একই আছে। কলেজ চত্বরেই বিমর্ষ ঘোরাঘুরি করে আমাদের সময় পার করতে হয়।

 

ওড়না বস্তুটি আমার যেমন অপছন্দ, চন্দনারও। ও বস্তুটি ধারণ না করেই আমরা মাঝে মধ্যে উদয় হই কলেজে। কলেজের ছাত্রী শিক্ষকদের ছানাবড়া চোখের সামনে বুঝি যে এমন অবশ্য-জরুরি বস্তুটিকে নির্বাসন দিয়েছি বলে সকলেই মর্মাহত। কারও মর্মের প্রতি উদার হওয়া আমাদের চমের্ তত নেই। কলেজ শুরু হওয়ার পর শিক্ষক শিক্ষিকা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি তাতে অন্তত এইটুকু বুঝি যে অংকের শিক্ষক দেবনাথ চক্রবর্তীর ক্লাস জগত উল্টো গেলেও ফাঁকি দেওয়া চলবে না। বাকি শিক্ষক শিক্ষিকাদের ক্লাস খুব প্রয়োজন না হলে বাদ। বাংলার শিক্ষক আবদুল হাকিম যিনি মোর বলতে গিয়ে মুর বলেন, একই রকম চোরকে চুর, তোরাকে তুরা, জোড়াকে জুড়া—তাঁর ক্লাসে গিয়ে চিরকুট চালাচালি কর, হাকিমবাবুর ছবি আঁকো, চঞ্চুনাশা, কদমছাঁট চুল, নাকে ঝোলা চশমা; পুস্তকি পদ্যে মন বসানোর কোনও কারণ নেই যেহেতু মন আমাদের অনেক আগেই পদ্যাক্রান্ত। শ্রীমতী সুমিতা নাহাও বাংলা পড়ান, তিনি যখন বাংলা গদ্য পদ্যের বর্ণনা করেন, প্রথম সারির মেয়ে ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই তাঁর কণ্ঠস্বর শোনে, কণ্ঠস্বরটিকে মাটির কাছাকাছি রেখে একরকম বাঁচিয়ে চলেন তিনি, যথেষ্ট উঁচুতে উঠলে সে স্বরের ভপূাতিত হওয়ার আশংকা আছে বলেই হয়ত। তিনি নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী,তাঁর স্বামী আলোকময় নাহাও শিল্পী। শিল্পী আবার রাজনীতিবিদও। একবার ভোটে দাঁড়ালেন তো পাশ করে গেলেন। ভাল রাজনীতিবিদ তিনি, সে কারণে নয়। ভাল গায়ক তিনি, সে কারণেই। রসায়নবিজ্ঞানের শিক্ষিকা নাক সবসময় কুঁচকে রাখেন, যেন পৃথিবীর প্রতিটি ববস্তু থেকে দগুর্ ন্ধ বেরোচ্ছে। নাকি সুরে রসায়ন পড়ান। কি পড়াচ্ছেন ক্লাসের মেয়েরা কেউ বুঝুক না বুঝুক, তিনি পড়িয়ে যান। ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্চিত নাক নিয়েই বেরিয়ে যান। হঠাৎ একদিন রসায়ন ক্লাসে হাসির দমক থামাতে না পেরে আমি আর চন্দনা শাস্তি হিসেবে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আহলাদে বাঁচি না। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ঠোঁটে যে বঙ্কিম হাসি ঝুলিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, তাতে কোন কোন মেয়ের হৃদয়ে উষ্ণ হাওয়া বয় তা অনুমান করতে চেষ্টা করি আমি আর চন্দনা দুজনই। জীববিজ্ঞান ক্লাসে খানিকটা ঢেউ ওঠে, ব্যাঙ ধরে মোমের ট্রেতে ব্যাঙকে চিৎ করে শুইয়ে বুকপেট কেটে দেখাতে হবে পাকতন।্ত্র মোটা শাদা কাগজে আঁকতে হবে নানারকম জীবজন্তুর ছবি। ছবি মানেই আমার রাজত্ব। সারাদিনই এইচবি, বি, থ্রিবি ইত্যাদি নানা নামের পেনসিল দিয়ে কারুকাজ করে ছবি আঁকি, যেন ছবি আঁকার ইশকুলে ভর্তি হয়েছি। দেখে বাবা বলেন, ফালতু কাম রাইখা বইয়ের পড়া মখু স্ত কর। বাবার কাছে জীববিজ্ঞানের ছবি আঁকাও ফালতু। ব্যাঙ নিয়ে যেতে হবে কলেজে, ব্যাঙএর পেছনে উঠোন জুড়ে দৌড় শুরু হয়। ব্যাঙ দৌড়োয়, পেছনে আমরা দৌড়োই। আমি, ইয়াসমিন, মা। শেষ অবদি ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটি সোনাব্যাঙ কাগজের ঠোঙায় ভরে কলেজে নিয়ে ব্যাঙএর হাত পা টেনে পেরেক লাগিয়ে কেটে পাকতন ্ত্র দেখাই বটে, কিন্তু ব্যাঙএর মায়ায় আমি এমনই উদাস বসে থাকি যে চন্দনা এসে গা ধাক্কা দিলে চেতন ফেরে, চেতন ফেরা মানে বেরিয়ে যাওয়া। ক্লাসঘরের দমবন্ধ আবহাওয়ায় যত কম থাকা যায়, তত মঙ্গল। বেরিয়ে যাই জীববিজ্ঞানের ল্যাবরটরি থেকে। আমাদের পাখা মেলতে ইচ্ছে করে। বন্ধন ভাঙার জন্য ভেতরে প্রবল তৃষ্ণার জন্ম হয়। সেই তৃষ্ণা নিয়ে, যেহেতু সীমানা ডিঙোনো চলবে না, মাঠের শেষমাথার শিমুলতলায় বসে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে কবিতা পড়ি দুজন দুজনের। পুরো কলেজের ছাত্রীরা আমাদের পলকহীন চোখে দেখে, আমরা নাকি অন্যরকম, ঠিক স্বাভাবিক নই। চন্দনা কলেজে আসার পথে এক ছেলের প্রেমে তখন পড়ছে পড়ছে, ওর পড়ছে পড়ছের গল্প শুনে আমারও ইচ্ছে হয় এই শাদামাটা জীবনে


Rx Munna

446 Blog mga post

Mga komento