সেঁজুতি

আমাকে হঠাৎ একা করে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর চন্দনা চলে গেল। চন্দনা তো আর গেল না, ওকে

আমাকে হঠাৎ একা করে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর চন্দনা চলে গেল। চন্দনা তো আর গেল না, ওকে ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন ওর বাবা ডাক্তার সুব্রত চাকমা, পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি, চন্দনাকে জন্ম দেবার পর দু দুটো ছেলে-বাচ্চার জন্ম দিয়ে স্বামীর আশা পূরণ করেছিলেন যে মলিনা সেই মলিনার মলিন স্বামী; কুমিল্লায়। কুমিল্লা যাওয়ার আগে দাদা আমাকে আর চন্দনাকে নিয়ে ঢাকা বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট তুলতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে যাওয়া বিকেলে ফেরা। মতিঝিলে টাই টুং চিনে রেস্তোরাঁয় দুপুরে আমাদের খাওয়াতে নিয়ে দাদা বললেন, কি চন্দনা, তোমরা চোখ কান খোলা রাখো না কেন?

 

কেন,কি দেখি নাই কি শুনি নাই?

 

একটা সুন্দরী মেয়ে দেখবা না আমার জন্য? কলেজে দুইটা বছর পড়লা!

 

আমরা ছেলেদের দিকে তাকাইয়াই সময় পাই না। মেয়েদের দিকে কখন তাকাবো! চন্দনা হেসে ফেলে। অনাত্মীয় পুরুষদের মধ্যে চন্দনা আমার দাদাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি য়চ্ছন্দ। চাকমা রাজা দেবাশীষের কথা মনে করে চুক চুক দুঃখ করে দাদা বলেন, যে ভুলটা তুমি করছ, পরে কিন্তু এর জন্য পস্তাইবা। একটা রাজারে পাত্তা দিলা না!

 

চন্দনা জোরে হেসে ওঠে।

 

দাদার দুঃখ শেষ হয় না। আমরা রাঙামাটিতে গেলে রাজার বাড়ির অতিথি হইয়া থাকতে পারতাম! এই সুযোগটা নষ্ট কইরা দিলা।

 

চন্দনা আবারও হাসে।

 

না জানি তোমার কপালে কোন ফকির আছে!

 

রাঙামাটির গল্প বলতে গিয়ে দেবাশীষের চেয়ে ও বেশি বলে চেরাগ আলীর কথা। রাঙামাটিতে এক দারোগা আছে, দারোগার নাম চেরাগ আলী, চেরাগ আলী বলেন, তিনি দিনেও জ্বলেন রাতেও জ্বলেন। চন্দনা খানিকপর গম্ভীর হয়ে বলে, তবে চেরাগ আলী ইদানিং কিছু কম জ্বলেন, কারণ তাঁর চাকরিটি চলে গেছে। যদিও অল্প সময় ঢাকায়, তবওু চন্দনা আর আমি ময়মনসিংহের চেনা পরিবেশ থেকে দূরে যেতে পেরে সুখের দোলনায় দুলি। কুমিল্লা যাওয়ার আগে বলেছিলাম চন্দনাকে, যাইস না, তুই গেলে বাঁচবাম কেমনে? চন্দনারও একই প্রশ্ন ছিল, আমাদের প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই কারও কাছে। সুব্রত চাকমাকে চন্দনা এমনও বলেছে সে ময়মনসিংহ ছেড়ে যাবে না, এখানে আমার সঙ্গে অবকাশে থেকে লেখাপড়া করবে।তিনি রাজি হননি। চন্দনার আধবোজা চোখ লাল হয়ে ছিল যাবার দিন। আমার কানে কানে বলেছে, দেখিস আমি পলাইয়া একদিন চইলা আইয়াম তর কাছে। আমরা দুইজন সারাজীবন একসাথে থাকবাম। কুমিল্লা থেকে দিনে দুটি তিনটি করে চিঠি লিখছে চন্দনা। লম্বা লম্বা চিঠি। প্রতিদিনের প্রতিটি ঘটনা, দুর্ঘটনা। প্রতিদিনের মন কেমন করা। প্রতিদিনের নিঃসঙ্গতা। প্রতিদিনের হাহাকার। বাড়ির কাছে কৃষ্ণচুড়া ফুটে লাল হয়ে আছে, গাছটির দিকে যখনই তাকায় ও, আমাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে ফেলে যাওয়া জীবনের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কুঁড়ি, প্রতিটি ফুল। জীবনটি ওর আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। চন্দনার এই যাওয়াকে আমার যাওয়া বলে মনে হয় না। মনে হয় আবার ফিরে আসার জন্য গেছে সে। এ যাওয়া সারাজীবনের মত চলে যাওয়া নয়। আমাদের আবার দেখা হবে, আমরা আবার দুলব আনন্দ দোলনায়। আবার সেই নৌকোর গলুইয়ে বসে আমি আকাশের রং দেখব, আর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে চন্দনা বৈঠা বেয়ে চলে যাবে বহু দূরে, সীমানা পেরিয়ে। এমন একটি জগতে যেখানে কোনও পাপ নেই, পঙ্কিলতা নেই, হিংসা নেই, ঘণৃা নেই, নিষ্ঠুরতা নির্মমতা নেই, যেখানে কোনও অন্যায় নেই, বৈষম্য নেই,যেখানে কোনও রোগ নেই, শোক নেই, মৃত্যু নেই। যেখানে শুভ্রতার ঘ্রাণ নিতে নিতে সুন্দরের সঙ্গে বাস করব আমরা, ভালবাসা আমাদের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও যাবে না। চন্দনা ভাল না লাগায় ভগু তে ভগু তে লেখে আমার ভাল লাগছে না, আমি যেন জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধে। ভাল লাগা ভালবাসা এসব শব্দগুলো সব পুরোনো মনে হচ্ছে। আমি তোকে বোঝাতে পারছি না। কেবল মনে হচ্ছে আমি যেন আমাতে নেই। আজ সারাদিন মন খারাপ, সামান্য আঘাত লেগে মেহগিনি পাতাগুলো যখন ঝিরঝির ফুলের মত প্রশান্তির মত ঝরে পড়ে তখন ইচ্ছে করে কোনও জিনস জ্যাকেটের পিঠে মাথা রেখে হোন্ডায় চড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই। আমি জানি, কি নির্মম ভাবে জানি অথচ বলিনি কারও কাছে এসব আমার জন্য কেবল অলীক স্বপ্ন মাত্র। আমাকে আঘাত কর তুই, চোখে জল না থাকলে আমি ভাল থাকি না তো, কিছুতেই না, আসলে আমার কি হয়েছে আমি তোকে বলতে পারব না, তাহলে জেনে যাবে, সবাই জেনে যাবে। আমি কেবল ছটফট করছি, আকুল হয়ে মরছি অথচ কি জানিস পুরো ব্যাপারটা তুই জানবি না, নেভার, তুই আমার এত আপন, এত ঘনিষ্ঠ, হৃদয়ের এত কাছে থাকিস তুই, তবু বলা হবে না। হায়রে মন। এই মনটাই আমার শত্রু। সব যখন ঠিকঠাক চলে, ঠিক সে মুহূর্তেই আমি বদলে যাই। মন নামক এই পদার্থটি বিট্রে করে বসে আমার সঙ্গে। আমি ভাল নেই, একদম না, চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, একধরনের ঈর্ষায় হিংসেয় আমি ছিন্নভিন্ন হই অবিরত, অথচ বোঝাতে পারি না। বুঝতেও পারি না এই ঈর্ষা কার বিরুদ্ধে, এই দ্বন্দ ্ব কেন। তবে কি আমি আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চাই? আমি কি আমাকে আর ভালবাসি না? কি জানি .. যদি কোনও এক নীল চোখের গ্রীক যুবক, যদি কোনও এপোলো আমাকে ভালবাসার কথা বলত ..! আমার ভেতর সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। আমি আর কোনওকিছুতে আনন্দ পাই না। মনে পড়ে আসামী হাজিরের সদানন্দ কি এক অব্যক্ত যনণ্ত্রায় আর্তনাদ করত, মনে কর তেমন কোনও অব্যক্ত যন্ত্রণায় আমি আর্তনাদ করছি। এই একঘেয়ে জীবন আর ভাল লাগে না। তুই আমাকে মনোহর উত্তরণে নিয়ে যেতে পারবি? মন কাঁদে, তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার, তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে মন মনরে আমার। বুঝতে পারিস কি বললাম? বুঝিস না? আমি তোকে কাছে পেতে চাইছি। আমি কেবল তোকেই চাই, কতকাল দেখিনি তোকে। এই সংসার এই মায়ার বন্ধন ছেড়ে চল ঘুরে বেড়াই বাউলের একতারা নিয়ে, তুই হবি বৈষ্ণব আমি বৈষ্ণবি, টুং টাং শব্দ তুলে আমরা গাইব দুজনেই, পাখি ছটফটাইয়া মরে, শিকল ছিঁড়িতে না পারে, খাঁচা ভাঙিতে না পারে, পাখি ছটফটাইয়া মরে। অথবা চোক্ষেরই নাম আরশিনগর, একদিন ক্ষইয়া যাবে, পোড়া চোখে যা দেখিলাম তাই রইয়া যাবে।

 

 

 

চন্দনাকে দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লেখা ছাড়া ছাদে, ঘরের কোণে, বারান্দায়, মাঠের ঘাসে, ভোরের শিউলিতলায়, সেগুন গাছের ছায়ায় বসে একটি জিনিসই তখন হয়, কবিতা লেখা। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে কবিতা পত্রিকা আসে আমার ঠিকানায়। পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চল থেকেও আসে কবিতার ছোট কাগজ। এগুলো এক ধরনের শেকলের মত, একটি থেকে আরেকটি, আরেকটি থেকে আরেকটি করে করে ব্যাপ্ত হতে থাকে। ছোট কবিতা পত্রিকায়, ঢাকার সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও পাঠাই কবিতা। কোথাও না কোথাও ছাপা হতে থাকে কিছু না কিছু একদিন আমার ভাবনার পুকুরে ঢিল পড়ে, কোত্থেকে পড়ে, কি করে পড়ে কিছু না জেনে আমি পুকুর পাড়ে নিস্পন্দ বসে থাকি। পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ ক্রমে বড় হতে হতে পায়ে আছড়ে পড়ে, আমার শরীর ভিজতে থাকে জলে। আমি তবু নিস্পন্দ বসে থাকি। নিস্পন্দ আমাকে দেখতে লাগে, ভেতরে আমার উঁকি দিচ্ছে একটি ইচ্ছের অঙ্কুর। আমি তো চেষ্টা করলে নিজেই একটি কবিতা পত্রিকা বের করতে পারি। পারি না কি? পারি। মন বলে পারি। ডলি পালের বাড়ি থেকে ভেসে আসা উলুধ্বনির শব্দ আমাকে সচকিত করে। দশদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কী নাম দেব পত্রিকার? কী দেব নাম? আমাকে দুদিন কিংবা তিনদিন ভাবতে হয় না। মন বলে, সেঁজুতি! হ্যাঁ সেঁজুতিই। সন্ধ্যাপ্রদীপ। চন্দনার কাছে চাওয়ামাত্র কবিতা পাঠিয়ে দেয়, ইশকুল শেষ হওয়ার পরও বাংলার শিক্ষিকা সুরাইয়া বেগম আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, তাঁকে দিয়ে নতুন একটি কবিতা লিখিয়ে নিই আর ছোটদাকে বলে শহরের কিছু কবির কবিতা আনিয়ে শখের বশে সুখের ঘোরে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলি সেঁজুতির, কিছু টুকরো খবর শেষের পাতায়, সাহিত্যের সাহিত্যিকের, সাহিত্যের কোন ছোট পত্রিকা কোত্থেকে কারা বের করেছে, কেমন হয়েছে ভাল না মন্দ, মন্দ হলে কেন ভাল হলে তাই বা কেন, এসব। দাদা বললেন আমার একটা কবিতা ছাপা। তাঁর কবিতার খাতা থেকে সবচেয়ে ভাল কবিতাটি নিই। আমার খবরটাও লেইখা দে। লেইখা দে পাতা পত্রিকার সম্পাদক ফয়জুল কবীর নোমানএর প্রথম কবিতার বই পারাপার শিগরি বেরোচ্ছে। তাও লিখে দিই। দাদা খুশি। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাজানোর সময় হয়ে এল, কে টাকা দেবে, কে প্রেসে যাবে, কে ছেপে আনবে সেঁজুতি! পারাপার নামে দাদা কোনও বই লেখা শুরুই করেননি, তবু তাঁর অনুরোধে খবরটি দেবার কারণেই সম্ভবত তিনি বললেন ঠিক আছে যা, আমি তর এই সেঁজুতি ছাপার খরচ দিয়াম নে। প্রেসের সবাইরে তো আমি চিনি, পাতা পত্রিকা ছাপানোর কারণে। দাদার কানের কাছে পিনপিন করে বেজেই চলল আমার গানা ও দাদা, ও দাদা, তুমি তো কইছ ছাপাইয়া দিবা, দেও।

 

ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধর।

ধৈর্য আর কত ধরাম?

আরও ধৈর্য ধর। আরও।

কতদিন?

আরও কিছুদিন।

 

ধৈর্য ধরা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। দিন দিন অস্থির হতে থাকি। শেষ অবদি ছোটদার হাতে পাণ্ডুলিপি দিই। ছোটবাজারের একটি ছাপাখানায় সেঁজুতি দিয়ে আসার পর ছোটদার লেজে লেগে থাকি, কবে ছাপা হবে? ছাপার দেরি আছে। কত দেরি? সামনের মাসে ছাপা হইব। উফ এত দেরি! প্রেসের কি আর কাজ নাই নাকি?

 

আমারে একদিন নিয়া যাইবা ছাপাখানায়? তুই যাইতি কেন? আমিই ছাপাইয়া নিয়া আসব।

 

ছাপাখানায় যাওয়ার ইচ্ছেজ্ঞটর গলা ধরে দাদা ধাক্কা দেন, প্রেসে যাইবি কেন?

 

কেমনে ছাপায় দেখতে ইচ্ছা করতাছে।

 

মেয়েরা প্রেসে যায় না।

 

কেন যায় না?

 

যায় না।

 

কোনও কারণ আছে?

 

মেয়েদের প্রেসে যাইতে হয় না।

 

কেন হয় না? গেলে কি হয়?

 

অসুবিধা হয়।

 

কি অসুবিধা? মাইনষে চাক্কাইব?

 

চাক্কাইব না হয়ত, কিন্তু হাসব।

 

হাসব কেন? হাসির কি আছে? আমি সম্পাদনা করতাছি পত্রিকা, আমি কেন প্রেসে যাব না?

 

সম্পাদনা ঘরে বইয়া করা যায়। পুরুষমানুষের মত প্রেসে দৌড়ানোর দরকার নাই। দাদা আমার উৎসাহ নিবৃত্ত করতে পারেন না। ছোটদার সঙ্গে প্রেসে আমি যাই যে করেই হোক যাই। কালো কালো কাত করা ঘরকাটা বড় টেবিল মত, তার সামনে বসে লোকেরা এক একটি ঘর থেকে এক একটি ক্ষুদ্র বণর্ নিয়ে লোহার পাতে রাখছে। তুমি লিখতে গিয়ে, ত এর ঘর থেকে ত তুলে,ুর ঘর থেকেু তারপর একটি িনিয়ে তার পাশে ম বসাচ্ছে। এক তুমিতেই চারবার হাত বাড়াতে হয়। কি করে লোকেরা জানে কোন ঘরে ত আছে, কোন ঘরে ম, কি করে হাতগুলো এত দ্রুত সঞ্চালিত হয়! ইচ্ছে করে সারাদিন বসে প্রেসের কাজ দেখি, দেখি কি করে অক্ষর জুড়ে শব্দ বানায় ওরা। ছাপার মেশিনটি ঘড়ঘড় শব্দে ছেপে যাচ্ছে বিড়ির কাগজ, আগরবাতির কাগজ, মলমের কৌটোর কাগজ,বিয়ের কাডর্, রাজনৈতিক পোস্টার। সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের মালিক হরে কৃষ্ণ সাহা অন্যরকম কিছুর স্বাদ পেয়ে অন্যরকম হাসি হাসলেন। ছেপে দেবেন শীঘ্র বললেন। প্রতি ফর্মা দুশ টাকা। কেবল দুশ টাকাই কি! আছে কাগজ কেনার টাকা। বাড়ি ফিরে শিশিবোতলকাগজঅলার কাছে বাড়িতে আস্ত অনাস্ত যত কাগজ আছে, পুরোনো চিত্রালী পূর্বাণী রোদে শুকিয়ে উই ঝেড়ে, পুরোনো রোববার সন্ধানী বিচিত্রার মায়া কাটিয়ে বিক্রি করে টাকা জমা করি। মার


Rx Munna

446 Blog Postagens

Comentários

📲 Download our app for a better experience!