নিঃসঙ্গতার সঙ্গ

নিঃসঙ্গতার সঙ্গ

বাবা যা বহাল করেন বাড়িতে, তা যে বছরের পর বছর

নিঃসঙ্গতার সঙ্গ

 

বাবা যা বহাল করেন বাড়িতে, তা যে বছরের পর বছর বহাল থাকে তা নয়। দড়ি তাঁর হাতে, যখন ইচ্ছে ঢিলে করেন, যখন ইচ্ছে শক্ত। তাঁর নেওয়া কিছু কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে তিনি হঠাৎ একদিন সরে আসেন। আমার কাছে পত্রমিতাদের চিঠি আর না আসতে থাকায় তিনি নতুন আসা ডাকপিয়নকে নতুন করে বাগিয়ে নিয়ে চিঠি হাত করতে চেষ্টা করেন না। ডাকপিয়ন আগের মত বাড়িতে চিঠি দিতে শুরু করেছে। রান্নাঘরের বন্ধ আলমারির তালা খুলে যেভাবে গুনে গুনে সবকিছু দিচ্ছিলেন তাতেও ভাটা পড়ে, তাঁর পক্ষে এত ঘন ঘন নতুন বাজার থেকে প্রতিবেলা রান্না চড়ানোর আগে বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। আলমারি এখন খোলাই থাকে। মা আগের মতই সংসারসমুদ্রে নিমজ্জিত হন। জরির মা চলে গেলে নানিবাড়ির পেছনের বস্তি থেকে মালেকাকে এনেছিলেন, সেই মালেকাও মাস পার না হতেই চলে গেছে, দুদিন এদিক ওদিক খুঁজে কাউকে না পেয়ে পাড়ার রাস্তায় ভিক্ষে করা হালিমাকে ধরে আনলেন মা। হালিমা তার মা সহ বাড়িতে বহাল হয়ে গেল। টুকটাক সওদা করতে গিয়ে রাস্তায় কোনও এক শিশিবোতলকাগজঅলার সঙ্গে দেখা হয় হালিমার, সেই অলা তাকে বিয়ে করবে বলেছে বলে খুশিতে সে আটখানা থেকে ষোলখানা হয়ে যায়। মা একটি রঙিন শাড়ি দিলেন হালিমাকে, কাগজঅলা জামাইকে একটি নতুন লুঙ্গি। বিয়ে হওয়া হালিমা সদপের্ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হালিমার মা একাই রয়ে গেল এ বাড়িতে। খুক খুক কাশতে কাশতে একা। একা তার পক্ষে বাড়ির সব কাজ করা কঠিন হয়ে ওঠে। গা প্রায়ই জ্বরে পুড়তে থাকে। যেদিন কাশির সঙ্গে দলা দলা রক্ত বেরোল, মা তাকে হাসপাতালে নিজে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে এলেন। দু সপ্তাহ পার না হতেই হালিমা ফিরে এল অবকাশে। কি হয়েছে? জামাই ভাত দেয় না।

 

হালিমা আগের মত বাসন ধোয়ায়, কাপড় ধোয়ায়, ঘর মোছায় লেগে গেল। থেকে থেকে কেবল বলে রাইতে ঘুমাইতে পারি নাই বেডার জ্বালায়। জ্বালাটি কি ধরনের জ্বালা শুনতে আমরা উৎসুক।

 

রাইতে ঘুমের মধ্যে শি.. শি.. বোত..ল কা….গজ কইয়া চিল্লাইয়া উডে। সারাদিন রাস্তায় ঘুইরা ঘুইরা কয় ত, রাইতে ঘুমাইয়াও রাইতেরে দিন মনে করে।

 

এই হালিমা আবার কিছুদিন পর রাস্তায় দেখা আরও এক কিঅলার প্রস্তাবে রাজি হয়ে অবকাশ ছাড়ে।

 

অবকাশে ভাসমান দরিদ্রদের আসা যাওয়ার খেলা দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের। কে আসছে কে যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে এসব নিয়ে কোনও গবেষণা চলে না। কাজের মানুষ থাকলে মার খানিকটা আরাম, না থাকলে মার কষ্ট। ব্যাপারটি সম্পণূর্ মার। কেউ থাকুক বা না থাকুক আমাদের আরামে কখনও কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। আমরা যেমন আছি তেমন থাকি। কাজের মানুষ পেতে আমাদের চেয়ে মার উৎসাহ তাই সবসময়ই বেশি। একবার হাঁটু অবদি তোলা লুঙ্গি, ছেঁড়া একটি গেঞ্জি গায়ে এক লোক ঢুকেছিল মাঠে। জোয়ান বয়স। লোকটিকে দেখেই আমার ডাকাত বলে সন্দেহ হয়। ডাকাত না হলে দা কেন হাতে!

 

কি চান? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি জানালায় দাঁড়িয়ে।

 

কাম করাইবাইন?

 

কি কাম?

 

দাওয়ের কাম।

 

দৌড়ে গিয়ে মাকে খবর দিই, একটা ডাকাত আইছে। কয় সে নাকি দাও এর কাম করে। দাওএর কাম মানে বুঝছ ত! দাও দিয়া খুন করার কাম।

 

মা মশলা বাটছিলেন, বললেন, খাড়ইতে ক।

 

আমি আর ওমুখো হই না। মা মশলা বাটা রেখে দরজা খুলে মাঠে গেলেন।

 

লোকটিকে দিব্যি বাড়ির ভেতরে এনে টিনের ঘরের পেছনের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে এক থাল ভাত দিলেন খেতে, সঙ্গে ডাল তো আছেই, এক টুকরো মাছও। মার কোনও ভয় ডর নেই। এ বাড়িতে এত চুরি হওয়ার পরও মার কাউকে চোর বলে মনে হয় না। ডাকাতির খবরও শোনেন মা, তবু মা কাউকে ডাকাত বলেও মনে করেন না। যখন হাভাতের মত খাচ্ছে লোকটি, মা বললেন, কি গো মিয়া তোমার কোনও মেয়ে নাই? এই ধর বারো তেরো বছর বয়স। যুবতী মেয়ে কাজে রাখতে ভয় হয় মার। তাই মেয়ে চাইলে বারো তেরোর বেশি এগোতে চান না। আর বেশি বয়স হলে চল্লিশের নিচে নয়।

 

লোক বলল, আফা, আমার একটাই ছেলে, মেয়ে নাই।

 

ছেলের বয়স কত?

 

লোক ছেলের বয়স বলতে পারল না। দাঁড়িয়ে পেট বরাবর বাঁ হাত রেখে মাপ দেখালো, আমার পেট সমান লম্বা।

 

কামে দিয়া দেও ছেড়ারে। কি কও!ফুট ফরমাইসটা ত অন্তত করতে পারব।

 

লোকটি মার ব্যবহারে মগ্ধু হয়ে পরদিন নজরুলকে নিয়ে এল। নজরুল পেটে ভাতে থাকবে। দাওয়ের কাম করতে গিয়ে এ পাড়ায় এলে লোক তার ছেলেকে দেখে যেতে পারবে। লোক যতবার আসে, মা ভাত দেন খেতে। লোক খুশি মনে ছেলেকে একনজর দেখে চলে যায়। নজরুল প্রায় দুবছর মত টানা ছিল এ বাড়িতে। দু বছর পর একদিন পালিয়ে চলে গেল, তারপর মাস দুই গেলে আবার সেই নজরুলকে তার বাবা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের কাছে। রাতে সব কাজ শেষ করে সে ঘরে এসে যাত্রার রাজার ভূমিকায় অভিনয় করত। একাই করত। আমরা ছিলাম দর্শক, শ্রোতা। মাঝে মাঝে আমাদের হাত ধরে নিয়ে যেত রানি হওয়ার জন্য মুখোমুখি দাঁড়াতে, হোক না সে সংলাপহীন। কি রে নজরুল বড় হইয়া কি হইবি রে? যাত্রায় পাট করবি? নজরুল চিকচিক চোখে বলত, হ। নজরুল রাধঁ তে পারত না প্রথম প্রথম। কাপড় ধুতেও পারত না। পরে সব শিখে গেছে। যখন সে তার বাবার বুক সমান লম্বা হল, তাকে দাওএর কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে গেল তার বাবা। যাবার দিন মা তাঁর আঁচলে আর তোশকের তলে গুঁড়ো পয়সা যা ছিল, জড়ো করে বারো টাকার মত, নজরুলের বাবার হাতে দিয়েছেন। বাড়িতে কোনও কাজের মানুষ না থাকলে মা নানির বাড়ির পেছনের বস্তিতে চলে যান, ওখানে না পেলে যান ব্রহ্মপুত্রের চরে, চরে ভাঙা বেড়া আর খড়ের ছাউনি দিয়ে ঘর তুলে দরিদ্র মানুষের বাস, এক ঘরে না পেলে আরেক ঘরে লোক মেলে। লোক না মিললে ভিক্ষে করতে যারা আসে, তাদের দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে দুপুরে ভাত খাইয়ে বেশি করে চাল দিয়ে দেন টোনায়। তারপরও যখন হাহাকার পড়ে, কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ঠেকার কাজ সামলাতে নান্দাইল থেকে কাউকে পাঠাতে বলেন বাবা। বেশির ভাগই বাবার নিজের আত্মীয়। খুব দূরের নয়, কাছেরই। নিজের বোনের মেয়ে। বাবার ছোট দু বোনের বিয়ে নান্দাইলের হালচাষ করা কৃষকের কাছেই হয়েছে। অসখু বিসুখে বোনেরা এ বাড়িতে এসে ডাক্তার ভাইকে অসখু দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে যায়। বোনের ছেলেরা বড় হয়েছে, একা একাই চলে আসে। আসে টাকা পয়সা সাহায্য চাইতে। দুদিন এ বাড়িতে থাকে খায়, বাবা ওদের ডেকে জমিজমার অবস্থা জিজ্ঞেস করে উপদেশ এবং অর্থ দুটোই বিতরণ করেন। বিয়ের বয়সী মেয়ে নিয়ে বোনেরা আসে। পাত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে, কিন্তু পাত্র চাকরি চায়। গ্রামের জমি চাষ করবে না, শহরে পাষনীর বড়লোক মামা থাকে, সেই মামা যদি চাকরি যোগাড় করে দেন তবে বিয়ে নচেৎ নয়। বাবা এদিক ওদিক চাকরি খোঁজেন। চাকরি দেনও ওদের। কিন্তু মেয়ে যদি বাবার কাছে বিচার নিয়ে আসে স্বামী মারধোর করে, বাবা বলেন, করুক। স্বামী মারধোর করুক, চাকরির পয়সা পেয়ে দুটো যদি ডালভাত খেতে দেয়, তবে মখু বুজে স্বামীর সংসার করতে উপদেশ দিয়ে ওদের বিদেয় করেন। আর স্বামী যখন বউ তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে, বাবা উঠে পড়ে লেগে যান স্বামীর চাকরিটি খেতে। বাবা তাঁর বোনের মেয়ে সুফির স্বামীকে ক্যাডেট কলেজে বই বাধাঁই করার চাকরি দিলেন। ফুটফুটে একটি মেয়ে হল সুফির। এরপর স্বামী সুফিকে মেরে বের করে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করল। সুফি এসে কেঁদে পড়ল বাবার পায়ে। বাবা বলেন, যা সতিনের ঘরে কাম কাজ কইরা বাঁইচা থাক। সুফি সতিনের ঘরে অনেকদিন ছিল, শেষে স্বামী আর ওকে ভাত দেয় না বলে চলে এল বাপের বাড়ি। বাপের বাড়িতে ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে বাড়তি ঝামেলা পড়ে থাকে মখু বুজে। ওকে একদিন নিয়ে আসা হল শহরে। বাইরের মানুষেরা সুফিকে কাজের মেয়ে বলেই মনে করে। বাড়ির মানুষ কেউ শুধরে দেয় না যে এ কাজের মেয়ে নয়। আমরা মাঝে মাঝে ভুলেও যাই যে সুফি আমাদের ফুপাতো বোন, বাবার আপন বোনের মেয়ে। কারণ সুফি বাড়িতে কাজের মেয়ের মতই কাজ করে। কাজের মেয়ে ঈদের সময় যে কাপড় পায়, সুফিও তাই পায়। যে এঁটোকাঁটা খেতে পায়, সুফিও সেই এঁটোকাঁটা পায়।

 

ধান ওঠার পর নান্দাইল থেকে বাড়ির লোকেরা যখন আসে, পিঠা নিয়ে আসে, মেড়া পিঠা। পিঠা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন দাদা। সেই মেড়া পিঠা ফালি ফালি করে কেটে ভেজে গুড় দিয়ে খাওয়া হয়। মাঝে মাঝে বড় পাতিলে করে শিং মাগুর মাছ পানিতে সাঁতার কাটছে, আনেন। কেউ কিছু আনলে মা খুশি হন। মাছ রান্না করে পাতে দিতে দিতে বলেন, মাছগুলা খুব তাজা ছিল, পুস্কুনির মাছ। কেউ ঝাল পিঠা আনলে দাদা একাই ভেতরের বারান্দার চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে অর্ধেকই খেয়ে ফেলেন। বাবার বড় বোনের অবস্থা ভাল। নান্দাইলের কাশিরামপুর গ্রামে


Rx Munna

446 Blog Postagens

Comentários