ফুলশয্যা
পুকুর দেখেছি, নদী দেখেছি, সমুদ্র দেখা হয়নি কোনওদিন। বউ নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা করে আসার পর দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদা গো সমুদ্র দেখতে কেমন! দাদা একটি কথাই বলেছেন,না গেলে বুঝবি না। সমুদ্র কেমন সে কথা কখনও বইলা বুঝানো যায় না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়া উপলব্ধি করতে হয় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দাদার উড়োজাহাজ নিয়ে। উড়োজাহাজে প্রথম চড়েছেন তিনি। ছোটদা উড়োজাহাজের গল্প করলে দাদা এতকাল তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। নয়নের সেই তৃষ্ণা দাদার ঘুচেছে এখন। আমার অবশ্য কিছুই ঘোচেনি। উড়োজাহাজের চেয়ে সমুদ্র দেখার উৎসাহটিই আমার বেশি।
সমুদ্রপাড়ে তোলা দাদা আর হাসিনার ছবি দেখে, সমুদ্র না দেখেই লিখে ফেলি সমুদ্র নিয়ে তিনটে কবিতা। না দেখা সমুদ্র যখন আমার হৃদয় জুড়ে, তখনই চল চল সমুদ্র দেখবে চল, কাপড় চোপড় গোছাও রব। চতথুর্ বষের্ এই একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে, এক ক্লাস ছাত্রছাত্রী নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষকরা দূরে কোথাও চলে যান, দূর বলতে দেশের মাথা থেকে লেজে যাওয়া, লেজের কাছে থই থই করছে রূপোলি জল, সেই জলে ডোবো, ভাসো। অবশ্য বলা হয় জলীয় আবহাওয়া দেখাতে নিচ্ছেন, আসলে এ অনেকটা হাওয়া বদলের মত, রোগীদের যেমন হাওয়া বদলের দরকার হয়, হবু ডাক্তারদেরও হয়। দিনরাত হাসপাতালের পুঁজ-গন্ধময় হাওয়া থেকে খানিকটা নিস্তার পাওয়া হয়।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে কক্সবাজার। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল, হইচইই বটে, এমন তো কখনও ঘটে না, আত্মীয় কাউকে না নিয়ে দূরের কোনও শহরে চলে যাওয়া। মা বার বার জিজ্ঞেস করলেন মাস্টাররা থাকবে তো! দুঘন্টার পথ ঢাকা, ঠিক আছে মানায়, ঢাকায় আত্মীয়ও আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তো আমার মামাও থাকে না কাকাও না। মামা কাকার সীমানার বাইরে বলেই সম্ভবত পেখম মেলে একশ ময়ূর নাচে হৃদয়ে। বাবা দরাজ হসে ্ত দিয়েছেন টাকা, হাইজিন ট্যুরের চাঁদা তো আছেই, বাড়তি টাকাও। ট্রেনে চড়ে দলের ঢাকা যাত্রা হয়। সেগুনবাগিচা ছেড়ে ছোটদা এখন নয়াপল্টনে বাড়ি ভাড়া করেছেন। নয়াপল্টনে একরাত থেকে পরদিন কমলাপুর রেলইষ্টিশনে পৌঁছতে হবে সকাল আটটায়। রাতে গীতার কাছে শাড়ি চাইতেই আলমারি খুলে বিছানায় লাল নীল সবুজ হলুদ কাতান সিল্ক এমনকি মসলিন বিছিয়ে দিল পছন্দ করে নিতে একটি নয়, যত খুশি। বোতাম টিপলে আলো জ্বলে এমন একটি ক্যামেরাও মিলল। আর কি চাই! আশাতীত পাওয়া আমার।
পরদিন ট্রেনে চড়ে কখনও হৈ হল্লায় মেতে, কখনও জানালায় উদাস চোখ মেলে পৌঁছই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বনের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে সারি সারি রাবার গাছের বাগান পার হয়ে কক্সবাজার যখন পৌঁছই, উত্তেজনা তুঙ্গে। একটি শব্দ, ভীষণ এক শব্দ, অন্যরকম, মাটি কাঁপানো, জল কাপাঁনো, শব্দটির দিকেই বাস যেতে থাকে। ঠিক কোত্থেকে শব্দটি আসছে বুঝতে আমি চারদিক খুঁজি। বাসের জানালা থেকে কিছুতেই চোখ সরে না। দূরে একটি শাদা কিছু একবার উঠছে একবার নামছে। সাফিনাজ, হালকা হালকা বন্ধুত্ব অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হওয়া একজন, জানালায় ঝুঁকে বলল,ওইটাই কি সমুদ্র নাকি! কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে আমি, ইচ্ছে করে, বাস থেকে নেমে দৌড়ে যাই দেখতে ,যদি ওটাই সমুদ্র হয়, কিন্তু কে দেবে আমাকে ছুটে যেতে! আগে মোটেলে নামো, তারপর। মোটেলে দুজনের জায়গায় চারজনকে ঢোকানো হল এক ঘরে। বরাদ্দ ঘরে সুটকেস নামিয়ে রেখে আগে দৌড়ে যাই ওই শব্দের দিকে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। আগে আমি সমুদ্র দেখব তারপর অন্য কিছু সাফিনাজ পরিপাটি মেয়ে, খাওয়ার সময় খাওয়া পড়ার সময় পড়া ঘুমের সময় ঘুমের মেয়ে। ওকে যেতে হয় আমার উত্তেজনাকে সঙ্গ দিতে। সেই তীব্র র্গজনের দিকে হেঁটে নয়, দৌড়ে যাই। যখন পৌঁছই, বিস্ময় আর মগ্ধু তা আমাকে স্থবির করে রাখে, আমাকে নিস্পন্দ করে রাখে,আমাকে বিবশ করে রাখে। একটি শব্দ আমি আর উচ্চারণ করতে পারি না। এত বিশাল কিছু এত অদ্ভুত সুন্দর কিছু এত আশ্চর্য হৃদয়রঞ্জন কিছু আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। নানিবাড়ির ছোট্ট পুকুরের ধারে বড় হয়েছি, শহরের তিনকোনা পুকুর ছিল নানিবাড়ির পুকুরের চেয়ে