কাগজের বউ

কাগজের বউ

ডালিয়া জাহানের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসতে থাকে নিয়মিত। কখনও মোংলা বা মিঠেখালি

কাগজের বউ

 

ডালিয়া জাহানের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসতে থাকে নিয়মিত। কখনও মোংলা বা মিঠেখালি থেকে, কখনও ঢাকা থেকে। রুদ্রর চিঠি হাতে নিয়ে টের পাই বুকের মধ্যে কেমন করা।চঠি যেদিন পাই, এক অমল আনন্দ আমাকে সারাদিন ঘিরে থাকে।

 

তুমিহীন একটি মুহূতর্ এখন যে কত দুঃসহ তা তোমাকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। তোমাকে ছাড়া আমার দিনগুলো যে কি রকম বিশৃঙ্খল আর কি রকম অসংযত তুমি তো তা বুঝতেই চাও না। জানি, অনেক সমস্যা আছে, এ মুহূর্তে তোমাকে কাছে পেতে গেলে হাজার হাজার সমস্যা জেঁকে বসবে। পরেও কিন্তু এ সমস্যাগুলো আমাদের নিস্তার দেবে না। কাজেই যে সমস্যাকে একদিন না একদিন মোকাবেলা করতে হবে তাকে এখনই সামনে নিয়ে আসা উচিত। লুকোচুরি করে তো আর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্যেই দাদার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। আমরা বিয়ে করেছি এটা জানাতে চেয়েছিলাম, তুমি শুনলে না। আমার দিন আর রাত্রিগুলোকে অসংযম আর অনিয়মের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তুমি খুব সুখে আছো। তোমার এই উদাসীন ভাল থাকা আমাকে ভীষণ ঈর্ষাকাতর করে তোলে। আমি পারি না। আমি কোনোভাবেই নিজেকে বাধ্য রাখতে পারি না।

 

আকাশে মেঘের মত প্রতিদিন স্বপ্ন জমে বৃষ্টি হয় না। তুমিহীন দিন যায়, রাত্রি যায়। তোমার স্পর্শহীন এই ঊষর প্রান্তর…। কতদিন তোমাকে দেখি না! কতদিন তোমার আনতচোখদুটিকে আদর করি না! ভীষণ কুয়াশাচ্ছত তোমার চোখ, ভীষণ মেঘলা আর ভীষণ সুদূরের। কবে আমি ওই কুয়াশা পার হয়ে তোমাকে ছোঁবো! কবে আমি ওই মেঘের মানে বুঝতে পারব! অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রতীক্ষা আর ফুরোয় না। প্রিয় স্পর্শ নেই, দিনগুলো প্রাণহীন! প্রিয় স্পর্শ নেই, রাত্রিগুলো কি শীতল আর ক্লান্তিময়! এই শীতল আধাঁরে তুমি রোদের উত্তাপ নিয়ে কবে আসবে? আজ মন ভাল নেই, নির্জন আর সেই খুব শান্ত কষ্টগুলো সারাদিন আজ আমার বুকের ভেতরে জমে উঠেছে। কোনও ভাষায় আমি এই কষ্টগুলো বোঝাতে পারি না। মেঘলা আকাশের মত ভারি, শীতল আর কি শান্ত এই কষ্ট আমার!আজ আমার মন ভাল নেই। আজ খুব শীতল কষ্ট।

 

রুদ্রর কষ্টগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু আমার পক্ষে তার ইচ্ছেকে পণূর্ তা দেওয়া সম্ভব হয় না। রুদ্র স্বামীর দাবি নিয়ে বলে, বাড়িতে বল যে বিয়ে করেছি, নিজে বলতে না পারো কাউকে দিয়ে বলাও। এও যে সম্ভব নয়, তা আমি বারবার বলি। কোনও কাউকে দিয়ে এ কথাটি উচ্চারণ করানো যাবে না, যে, আমি এক চালচুলোহীন কবি কে বিয়ে করে বসে আছি। রুদ্রর ধারণা বিয়ের কথা বাড়িতে জানালে বাবা আমাদের আড়ম্বর করে বিয়ে দেবেন, তারপর আমি রুদ্রর সঙ্গে সংসার করতে চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে অথবা রুদ্রই এ বাড়িতে জামাই আদরে থাকবে অথবা বাড়ি থেকে যদি আমাকে তাড়িয়েও দেয় তবে আমি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাব, ছুটিছাটায় রুদ্রর কাছে ঢাকায় যাব অথবা এই কলেজ থেকে বদলি হয়ে অন্য কলেজে, যেন তার সঙ্গে সংসারও করতে পারি, কলেজেও যেতে পারি এমন অথবা অন্য কিছু অথবা লেখাপড়া ছেড়েই দেওয়া। সংসার করার জন্য রুদ্র উন্মাদ হলেও আমি হই না। রুদ্রই জীবনে একটি বড় অনিশ্চিতি, এরপর আরও একটি অনিশ্চিতিকে স্বাগত জানাতে আমার একবিন্দু সাহস হয় না।

 

রুদ্র ময়মনসিংহে আসে দেখা করতে। যেদিন আসার কথা থাকে আসতে পারে না। আমি দীর্ঘক্ষণ প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। কথা দেওয়া তারিখে সে যে সবসময় আসতে পারে, তা নয়। তবে যে করেই হোক, সে তারিখে না হোক, কাছাকাছি অন্য একটি তারিখ বেছে চলে আসে। কলেজ ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না তাছাড়া কলেজ ক্যান্টিন কলেজের ছাত্রছাত্রীর জন্য, ক্যান্টিনে রুদ্রর উপস্থিতি লোকে প্রথম প্রথম আড়চোখে দেখত, এখন বড় বড় চোখ করে দেখে। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর জমে ওঠাটিও খুব ভাল চোখে দেখা হয় না। আসাদ আর আনোয়ারকে মেডিকেলের খারাপ ছাত্র তো বটেই গুণ্ডা ছাত্র বলে মনে করা হয়, মেডিকেলে ঘটা যে কোনও খারাপ কাজের জন্য ওদের দায়ি করা হয়। ওরা মদ খায় বলেও গুঞ্জন আছে। রুদ্রকে কলেজের ক্যান্টিনে দেখে একদিন কথা বলতে এল আসাদ, দুজন নাকি একই কলেজে লেখাপড়া করেছে, একই ক্লাসে। ব্যস, হয়ে গেল। জমে গেল। ত্রাস দুটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ছাত্রছাত্রীরা, এক পথে ওদের আসতে দেখলে, বিশেষ করে ছাত্রীরা, অন্য পথ ধরে। কিন্তু ত্রাসদুটি আমাকে রুদ্রর সঙ্গে জমে ওঠার পর খাতির করে, কি নাসরিন কেমন আছো বলে এগিয়ে আসে দুজনই। আমারও হেসে বলতে হয় ভাল। ধীরে ধীরে একটি জিনিস আমি উপলব্ধি করি, ওরা আমার জন্য ত্রাস নয়, আর যার জন্যই হোক। রুদ্র না থাকলেও ওদের সঙ্গে বসে ক্যান্টিনে চা খেয়েছি, আসাদের হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বা আনোয়ারের কপালে কাটা দাগ হয়ত থাকে, কিন্তু কখনও মনে হয়নি ওরা খারাপ লোক, বরং অনেকের চেয়ে অনেক আন্তরিক আর সৎ মনে হয় ওদের। মাঝে মাঝেই ওরা বুক ফুলিয়ে বলে কেউ তোমারে ডিসটার্ব করে কিনা জানাইও, নাকের হাড্ডি ভাইঙ্গা দেওয়ার জন্য আমরা রেডি আছি। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর আড্ডা দেওয়া অন্য ছাত্রদের চোখ আরও বড় করে। দুপুরবেলা চা সিঙ্গারা খেয়ে আমাদের দুপুরের পেট কামড়ে ধরা ক্ষিধেও মরে না, একসময় উঠতেই হয়। কলেজে আসা যাওয়ার পথে সি কে ঘোষ রোডের প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনটি আবিস্কার করে ওতেই আজকাল দেখা করি রুদ্রর সঙ্গে। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে যে হলুদ রঙের বিরানি পাওয়া যায়, তা রীতিমত বিখ্যাত। রামপ্রসাদ বাবু মারা যাওয়ার পর তার ফটো টাঙিয়ে ফটোর ওপর মালা ঝুলিয়ে বাবুর ছেলে হরিপ্রসাদ নিজেই এখন সেই বিখ্যাত বিরানিটি রাঁধে। দুপুরে গিজগিজ ভিড়ের মধ্যে খাওয়া হয়, খেয়ে দেয়ে সব চলে যায়, আমরা বসে থাকি, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে। প্রেস ক্লাবের কর্মচারি আমাদের আড়ে আড়ে দেখে, দেখে যে আমরা যাচ্ছি না, একটু পর পর চা খেয়ে খেয়েও থেকে যেতে চাইছি। কোথাও কোনও নির্জন ঘরের ব্যবস্থা আমি করে রাখি না বলে রুদ্র অনুযোগ করে, মখু গোমড়া করে বসে থাকে। কর্মচারিরা ক্রমাগত আমাদের ইঙ্গিত করে উঠে যেতে, চেয়ারগুলোকে শব্দ করে করে টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখে, ওতেও যখন কাজ হয় না, মুখেই বলে দেয় ক্যান্টিন বন্ধ এখন। আমাদের ক্যান্টিন থেকে বেরোতে হয়, কিন্তু যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। একটু নির্জনতা খুঁজে বেড়াই সারা শহরে, জোটে না। অবশেষে মেডিকেল কলেজ চত্বর বিকেলে যখন নির্জন হয়ে আসে, বসি দুজন। দশ বছর বয়সী একটি পঙ্গু ছেলে পাশের বস্তি থেকে প্রায়ই হাঁটুতে হেঁটে এসে আমার পাশে বসে থাকে, ওর সঙ্গে কথা বলতে যত সহজ বোধ করি, রুদ্রর সঙ্গে নয়। ছেলেটির নাম দুলাল, বাবা নেই, মা আছে, অভাবের সংসার, নিজে ভিক্ষে করে সংসার চালায়, দুলালকে দু তিন টাকা যা থাকে পকেটে, দিই। জীবনের নানা রকম কথা রুদ্রর সঙ্গে বলি। চন্দনার কথা, চন্দনা ঢাকা এসেছে, স্বামীর বোনের বাড়ি উঠেছে, রুদ্রকে দেখা করতে বলি চন্দনার সঙ্গে, কেমন আছে ও, দেখে আসতে বলি, যদি দেখা করতে যায়, তবে তো কিছু আমি হাতে দিতে পারি, কি দিতে পারি, আমার ভাণ্ডারে যে একটি দামি জিনিস আছে, সেটিই দিই, দাদা তাঁর বিয়ের সময় যে হলুদ কাতান শাড়িটি দিয়েছিলেন, সেটি। চন্দনার জন্য মন কেমন করা, বিয়ের পর দাদার বদলে যাওয়া, ছোটদার না থাকার কারণে আমার একা হয়ে যাওয়া, পড়াশোনা ভাল না হওয়া ইত্যাদি কথা মৃদু স্বরে একটু একটু করে রুদ্রকে বলি। রুদ্র বার বার


Rx Munna

446 blog posts

Reacties

📲 Download our app for a better experience!