সংসার ধর্ম
হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এক বছর, না কম না বেশি। বছর শেষ হলে ঢাকায় পাকাপাকি ভাবে নিজের সংসারে ফিরব এরকমই কথা রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্রও মোংলা মিঠেখালির পাট চুকিয়ে ঢাকায় ফিরবে। শুরু হবে সংসার আমাদের। কোনও ছেদ না পড়া সংসার। পাকাপাকির আগেই অবশ্য নানা ছুতোয় আমার ঢাকা যাওয়া হতে থাকে, রুটিনে এক মাস গ্রাম পড়ল তো ঢাকা যাও, পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল তো ঢাকা যাও। ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙে টুকরো হয়নি, সামান্য ফেটেছে, ওটুকুর জন্যই হাড়ের ডাক্তার প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়ে বললেন, পুরো এক মাস। স্ত্রীরোগপ্রসুতিবিদ্যা বিভাগে তখনও আমার ডিউটি শেষ হয়নি, অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন, গলার দড়িতে নব্বই ডিগ্রি কোণে ঝুলে থাকা হাত দেখেই বললেন, ভাঙলা? হুম, ভাল একটা কারণ জুটে গেল ফাঁকি মারার, কি বল? না, জোবায়েদ হোসেন এটি ঠিক বলেননি। ডিউটিতে ফাঁকি মারার গোপন কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না।
হাত ভাঙা তো গা-গরম হওয়া বা খুসুখসে কাশির মত নয়, রীতিমত বড় একটি ঘটনা, এই ঘটনায় নিদ্বির্ধায় প্রশিক্ষণ কামাই করা যায়, বাঘ হয়েও জোবায়েদ হোসেন মেনেছেন, আমি না মানার কে! মা দুদিন মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন, গোসল করিয়ে জামা পরিয়ে দিলেন। মাকে ঠেলে সরিয়ে একদিন ঢাকায় রওনা হই। ঢাকা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হত না যদি না রুদ্র ময়মনসিংহে এসে সে রাতের ব্যাপারে স্বীকার করত যে সে রাতে সে মাতাল ছিল, যা করেছে কোনও সুস্থ মস্তিস্কে করে নি। আজকাল ঢাকা যেতে বাড়িতে কোনও কৈফিয়ত দিই না যে সার্টিফিকেট তুলতে হবে বা অপারেশন করাতে হবে বা অন্য কোনও বড় কারণ যে কারণে ঢাকা না গেলেই নয়। দিব্যি ঢাকা যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই, কোথায় থাকব কার বাড়িতে তাও বলি না, বলি না কারণ বাড়ির সবাই জানে আমি কোথায় কার কাছে যাই। এ নিয়ে কেউ আমার সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসে না। আমার ঢাকা যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই কলকলে বাড়িটি হঠাৎ চপু হয়ে যায়। ওই নৈঃশব্দ থেকে আমি নিঃশব্দে মিলিয়ে যাই। বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা যাওয়ার বাস, ঘন্টায় ঘন্টায় ছাড়ছে।
রুদ্র আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, যেহেতু আমার ডান হাতটি অকেজো। গোসলখানায় নিয়ে আমার কাপড় জামা খুলে গায়ে জল ঢেলে সাবান মেখে গোসল করিয়ে দেয়। গোসল করানোর সময় আমার শরীর স্পর্শ করে তার শরীরের ভেতর ফুঁসে উঠতে থাকে আরেকটি শরীর। নরম তোয়ালেয় গা মাথা মুছিয়ে আমাকে ঘরে আনে, শুইয়ে দেয়। উর্ধাঙ্গ অচল হলে কি হবে, নিম্নাঙ্গ তো অচল নয়। রাতে যখন গাছপালা দুলিয়ে মেঘ জমিয়ে ঘরে তুমুল তুফান তোলে রুদ্র, সেই তুফানে চৌকি ভেঙে পড়ে তলায় তোশক বালিশ সহ আমি। ভাল হাতটি ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙেনা। এর পরের তুফান মেঝের ওপর বয়, মেঝে ভেঙে নিয়ে নিচতলায় না পড়লেও মজবুত দেখে বড় একটি খাট কেনা হয়, যেন কোনও ঝড় তুফানে না ভেঙে পড়ে। বড় বিছানায় শুয়ে অভ্যেস আমার। হাত পা ছড়িয়ে শুতে না পারলে ঘুম ভাল হয় না। তার ওপর আবার কোলবালিশের ব্যাপারও আছে। মাথার বালিশকে কোলবালিশ করে আপাতত ঝড় তুফান শেষে নিদ্রা যাই। খাট কিনে তোশক বালিশ কিনে টাকা ফুরিয়ে যায়। টাকা ফুরোলে রুদ্র যা করে, মোংলা রওনা হয়। এবার আমাকে নিয়ে মোংলা যাবে সে। আমি বাধা দিই না। রুদ্রর সঙ্গ আমার প্রার্থিত। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে যেতে হলেও যাব, আর এ তো শ্বশুর বাড়ি!
হাত ভাঙা বলে কোনও লাল কাতান পরার দায় নেই, একরকম বাঁচি। লম্বা একটি ঢিলে জামা পরে থাকি, পরতে খুলতে সুবিধে। ঢাকা থেকে রেলে করে, লঞ্চে করে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মোংলায়, রূপসার ঘোলা জলের পাড়ে সেই নিঝুম বাড়িটিতে আবার, দোতলার ঘরটিতে আবার। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ, অথচ মনে হয় কেউ নেই বুঝি, কেউ ছিল না বুঝি! মানুষ খুঁজতে আমাকে ঘরে ঘরে উঁকি দিতে হয়। রুদ্রর মা তাঁর ভারি শরীরটি নিয়ে শুয়ে আছেন পালঙ্কে। বাকি ঘরগুলোয় আছে বাকিরা। বাকিরা যা কিছুই করছে, নিঃশব্দে করছে। পিঠাপিঠি ভাই বোন, অথচ কোনও চড়চিমটি-চুলোচুলো নেই। গোসলের সময় গোসল করছে, খাওয়ার সময় খাচ্ছে, ঘুমের সময় ঘুমোচ্ছে। চাবি দেওয়া যন্ত্রের মত, কাঁটায় কাঁটায় ঘটে যাচ্ছে সব, কিছুই পড়ে থাকছে না, কিছুরই এদিক ওদিক হয়না, এমন নিয়ম, পালনের প্রশ্ন ওঠে না, দেখলেই হাঁসফাঁস লাগে, আমি কোনও