শেফালিকে অবকাশে রেখে

শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভা??

শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।

 

বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।

 

দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও


Rx Munna

446 blog posts

Reacties