তাণ্ডব – ০১

ডায়রি লেখার অভ্যেস আমার মোটেও নেই। নতুন বছরের আগে আগে বেশ অনেক ডায়রি মেলে।

ডায়রি লেখার অভ্যেস আমার মোটেও নেই। নতুন বছরের আগে আগে বেশ অনেক ডায়রি মেলে। প্রতিটি নতুন বছর আসার আগে ভাবি নিয়মিত রোজনামচা লিখব। এমন নয় যে শুরু করি না। প্রথম দিন লিখতে গিয়ে পুরো পাতা ভরে গেল, এমনকী মার্জিনেও লিখতে হল, এত কথা মনে। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে মার্জিনে লেখার প্রয়োজন হল না। চতুর্থ দিনে পাতা অর্ধেক ভরল। পঞ্চম দিনে ভুলে গেছি লিখতে। ষষ্ঠ দিনের দিন বসে পঞ্চম আর ষষ্ঠ দুদিনের কথা লিখতে গিয়ে দেখা যায় কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লেখার। অর্ধেকের চেয়ে কম ভরল পাতা। এরপর পুরো তিন দিন রোজনামচা লেখার কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকি। হঠাৎ তিন দিন পর দুটো বাক্য লেখার পর তৃতীয় বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে তখনকার জন্য ডায়রির চেয়ে অধিক জরুরি কোনও একটি বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্রমে ক্রমে ডায়রির খাতাটির ওপর আরও বই খাতা জমে খাতাটি অদৃশ্য হয়ে থাকে কয়েক সপ্তাহ। তার পর একদিন টেবিল ঝেড়ে মুছে গোছাতে গিয়ে ধুলোর আস্তর জমে ওঠা ডায়রিটি হাতে পড়তে এক ঝলক আলো নাচে চোখে, মনে মনে বলি জ্ঞওহ তাই তো, আমার তো কথা ছিল প্রতিদিন এতে লিখব।’ কথা তো কত কিছুই থাকে। কটি কথা আর মানা হয়! টেবিল শেষ পর্যন্ত গোছানো হয় না, ডায়রির পাতা উল্টে উল্টে লেখাগুলো পড়ি। পড়তে পড়তে ভাবি, এখন থেকে বাকি দিনগুলোর কথা লিখে রাখব, জীবনের কত কথা ভুলে যাচ্ছি দিন দিন । যেদিন মনে হল, সেদিনের কথা দু ছষেন লিখে রেখে দিই, এর পর দিন লেখা আর হয় না। ভাবি এক সময় লেখা যাবে, এ আর এমন কী! মনে তো আছেই সব কিছু। মনে থাকবে। যে সব কাণ্ড ঘটে গেল, তা কি আর ভোলার মত। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করে খুব। যে ঘটনাটি কখনও ভোলার নয় বলে বিশ্বাস করি, সেটিই কদিন পর মনেই পড়ে না কখনও ঘটেছিল। মন এক আশ্চর্য জিনিস। কোনও এক দুপুরে একটি লাল জামা পরে জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে জাম খাচ্ছিল!ম, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু কোন বছর আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, সেটি দিব্যি ভুলে বসে আছি, এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করতে হয়। প্রয়োজনের কথাটি মনে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় কথায় মন বোঝাই হয়ে থাকে। মন জিনিসটি অদ্ভুত। কী জিনিস মন নেবে, কী নেবে না, তা আমার সাধ্য নেই অনুমান করি।

 

প্যারিসের দিনগুলির কিছু কিছু কথা জানি না কি কারণে লিখে রেখেছিলাম। কলকাতার দিনগুলির গল্প লিখে রাখলে সে গল্প শেষ হত না সহজে। কলকাতা প্যারিস নয়, কলকাতা আমাকে চেনে বেশি, প্যারিসের চেয়ে অনেক আপন এই কলকাতা, কলকাতা আমাকে নির্ভুল অনুবাদ করে। সবচেয়ে বড় কথা কলকাতাকে কখনও আমার বিদেশ বলে মনে হয় না। কলকাতায় পৌঁছে দেশে ফেরার মত আনন্দ হয় আমার। হোটেলে পৌঁছে সুটকেসটা রেখে বেরিয়ে যাবো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এরকম ইচ্ছে নিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি ঘরের দরজায় লোহা লককর লাগানো, দরজার কাছে পুলিশ বসা।

 

–এ কী রে বাবা, এসব কেন?

 

–মেটাল ডিটেকটর লাগানো হয়েছে। এ তোমার নিরাপত্তার জন্য।

 

–কলকাতায় আমাকে কে কি করবে? কলকাতার মত নিরাপদ জায়গা পৃথিবীর আর কোথায় আছে?

 

–কলকাতায় মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা কম নয়, তাদের মনে কী আছে কে জানে, সাবধানে থাকা ভাল।

 

মেটাল ডিটেকটর, পুলিশ পাহারা এসব আমাকে এমন লজ্জায় ফেলে যে মুখ গুঁজে বসে থাকি ঘরে। যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাবার, টই টই করে বাইরে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেজ্ঞটর পায়ে একটি রূপোর শেকল পরানো হয়েছে। কিন্তু শেকল আমার ভাল লাগবে কেন! পুলিশের দরকার নেই আমার, এ কথাটি জোর গলায় বলার পরও কেউ আমার কথা মানলেন না। দরজার পুলিশদের আমি চাইলেও বিদেয় করতে পারি না।

 

আমার কলকাতায় থাকার আয়োজনটি আনন্দবাজার থেকে করা হয়েছে। যেদিন পত্রিকা আপিসে যাই চেনা পরিচিতদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য, অভীক সরকারের সঙ্গে দেখা হয়। খুব ব্যস্ত মানুষ তিনি। গণ্ডা গণ্ডা পত্রিকার মালিক হলে ব্যস্ততা থাকেই। অভীক সরকারের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা কখনও হয় না, সম্ভব নয়। তাঁর সময় নেই। দুমিনিট কী তিনমিনিটের জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়াটাই সৌভাগ্য, সেটিরই ব্যবস্থা করতে অনেকদিন লেগে যায়। অভীক সরকার আমাকে একটি পরামর্শ দেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। এদিকে কিন্তু সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, যেন আর কোনও কাজ নেই জগত সংসারে, এক আমার সঙ্গে কথা বলাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। আমার ওপর এমন আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণটি হল ফতোয়া। পবিত্র কোরান ও মহানবী হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে আমার বইগুলোতে যেসব কথা আছে, সেসব পছন্দ হয়নি বলে সিলেটের হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। এছাড়া কলকাতায় আমি এখন জনপ্রিয় এক লেখক, আমার লজ্জা বইটি নিয়ে বিতর্ক চলেছে বছর ভর। এত সব কারণের পর সাংবাদিকরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না এ ভাবাই যায় না। বেশি কিছু নয়, একটি সাক্ষাৎকার চায় তারা, আধ ঘন্টা না হলে কুড়ি মিনিট, তা না হলেও অন্তত পাঁচ মিনিট। কিন্তু গণহারে সকলকে বিদেয় করা হল। কী বলতে আবার কী বলে ফেলি, কী লিখতে তারা আবার কী লিখে ফেলে, ওদিকে বাংলাদেশের হাওয়া তেতে আছে আগে থেকেই, সুতরাং মৌলবাদী থেকে তো সাবধান থাকতেই হবে, সাংবাদিক থেকেও সাবধান।

 

একদিন টেলিভিশনের লোক এল, সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন। তাঁকে না বলে দিই কী করে! আনন্দবাজারের কর্তারাও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনলে না বলতে পারেন না। আমি শরমে মরে যাই, আমি তো এত বড় হইনি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন! কিন্তু তিনি যখন নেবেনই, এবং আমার সাধ্য নেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া, অতএব প্রশ্নোত্তর (আমি কি জানি নাকি সব প্রশ্নের উত্তর!) বা সাক্ষাৎকারের মত না হয়ে আমিই প্রস্তাব করলাম এটি একটি আড্ডা হতে পারে। হল। দুই লেখকের আলাপচারিতা, এভাবেই ব্যাপারটিকে ধরে নেওয়া হল। কেবল তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই বন্ধু নন, সাংবাদিকদের মধ্যেও তো বন্ধু আছেন, তাঁদের যখন একের পর এক তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, বড় অপ্রতিভ বোধ করছিলাম। কতদিন পর দেখা, সাক্ষাৎকার না হোক, দুটো কথা হোক না! কবি গৌতম ঘোষ দস্তিদার প্রতিদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছেন, চোখের সামনে তাঁকেও তাড়ানো হল। বাহারউদ্দিনকে তো নিচ তলা থেকে ওপরে উঠতেই দেওয়া হয় নি। এ কি কাণ্ড। বন্ধুরাই তো তবে শষনু হয়ে যাবে! এভাবে গণহারে তাড়ানো হচ্ছে সাংবাদিকদের! গৌতম ঘোষ দস্তিদার, যে আমার বিষম প্রশংসা করে লজ্জা বইটির সমালোচনা লিখেছিলেন, তিনিই কিন্তু এরপর চোখ উল্টে দিলেন। এ নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি। সাক্ষাৎকার না দিলে পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখালেখি বন্ধ থাকবে, তা তো নয়, বরং বানিয়ে লেখা হবে। কথা বললে বরং বানানো গল্প থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। নিখিল সরকারকে


Rx Munna

446 بلاگ پوسٹس

تبصرے