অতলে অন্তরীণ – ১০

তেরো জুন, সোমবার

গভীর রাতে ক আর খ এসে আমাকে একটি গাড়ির পেছনে শুইয়ে নিয়ে

তেরো জুন, সোমবার

 

গভীর রাতে ক আর খ এসে আমাকে একটি গাড়ির পেছনে শুইয়ে নিয়ে গেলেন একটি দেয়ালঘেরা মাঠ অলা বাড়িতে। বাড়ির ভেতর বৈঠকঘরে বড় এক সোফা জুড়ে বসেছিলেন একজন রাশভারী মহিলা। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। এটি এমন এক দৃষ্টি যে দেখলে গা ছমছম করে। আমাকে বসতে বললেন গমগমে গলায়। গা ছমছম করলেও তিনিই আমার রক্ষক। তিনি আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন। জীবনে অনেক মেয়ের উপকার করেছেন তিনি, আমারও করছেন। আসলে চর বাড়ি ছাড়ার কারণটি হল, ক যা বলেছেন, যে, এক বাড়িতে বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। আত্মগোপনেরও পদ্ধতি আছে, আমার জানা ছিল না এতসব। এক জায়গায়, জায়গাটি নিরাপদ হলেও, দীর্ঘদিন থাকা চলবে না, স্থান বদল করতে হবে ঘন ঘন। আমার ধারণা, ক যদি আমার জন্য আশ্রয়ের জায়গা পেতেন, তবে তিনি প্রতিরাতেই আমাকে বেড়ালের মা যেমন তার ছানাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়, তেমন নিতেন। একটি ব্যাপার লক্ষ করেছি আমাকে যখন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, ক তখন কাউকে বলেন না কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। চ কে বলেননি যে ছ এর বাড়িতে যাচ্ছেন, ছ কেও বলেননি যে চ এর বাড়ি থেকে আমাকে আনা হল। ক এমনকী আমাকেও বলেন না কোথায় যাচ্ছেন। কোথাও পৌঁছে টের পেতে হয় কোথায় এসেছি। ছর বাড়িতে তুলে ছকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, ইনি ছ, ইনি বহুকাল থেকে নারী উন্নয়নের কাজে জড়িত। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার হয় না। আমি ফেরারি আসামী। ফেরারি আসামীকে যে কেউ দেখলে চেনে। কর কাছে জামিনের ব্যাপারে উকিল তাঁকে কিছু বলেছেন কি না জানতে চাই। ক আমাকে যা বললেন তা হল আমার উকিল শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন, কারণ গতকাল আদালতে যে বিচারক বসেছিলেন, তিনি ঘোর মৌলবাদী লোক। ওই বিচারক যে জামিন দেবে না, এ নিশ্চিত। যে কোনও বিচারকের সামনে আদালতে আমার জামিনের জন্য আমার উকিল চাইছেন না আবেদন করতে। ব্যাপারটি আমার জীবন মরণের ব্যাপার। কোনও বিচারকের ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি জামিন দিতে পারেন বা দেবেন তবেই আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আদালতে হাজির করার কথা বিবেচনা করা যায়। এ সময় আরেকটি ব্যাপারে ডঃ কামাল হোসেন চেষ্টা করছেন, তা হল আমার অনুপস্থিতিতে জামিন নেওয়া। এটি যদি হতে পারে, খানিকটা দেরি হলেও, ভাল। আততায়ীর গুলিতে আদালতে নিহত হবার ঝুঁকিটি তবে থাকে না। নিম্ন আদালত ইতিমধ্যে জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে, এখন ভরসা উμচ আদালতই। জামিন দেওয়া হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে তিনি এগোতে চাইছেন না। আমার বাড়ির কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়েছে কি না জানতে চাইলে ক বললেন, উকিলের আপিসে ছোটদা আর দাদার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। ক মিলনের কথা জিজ্ঞেস করে জানলেন যে মিলন এখনও বাড়ি ফেরেনি। দাদা আর ছোটদাকে কিছুক্ষণের জন্য মাত্র দেখেছেন ক, এটুকু শুনে আমার স্বস্তি হয়– যেন ক নয়, আমিই ওঁদের দেখেছি। দাদা এখন তবে ঢাকায়! যে লোক ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যেতে চাননা, তিনি এখন ঢাকায় আমার উকিলের আপিসে বসে আছেন! আমি অনুমান করতে পারি, আমার পরিবারের কারও জীবন আর আগের মত নেই। জীবন পাল্টে গেছে সবার।

 

ছ যে ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছেন, তা এ পর্যন্ত যত ঘরে থেকেছি তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল। পুরু গদির বিছানা, মাথার ওপর পাখা। বিছানার পাশে টেবিল, টেবিলে টেবিলল্যাম্প। দোযখ থেকে বেহেস্তে গেলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমন না হলেও কাছাকাছি ধরনের একরকম আনন্দ আমার হয়। বেহেস্ত বাস অনিশ্চিত বলেই বোধহয় আমার আনন্দ হলেও আনন্দ তেমন তীব্র হয় না। বেহেস্তে আমার আয়েশের জন্য বিছানা পাতা। বিছানায় পরিষ্কার চাদর। আপাতত সুনিদ্রা যাও তসলিমা, মনে মনে নিজেকে বলি। আসলে আজকাল আমি লক্ষ্য করেছি নিজেকে অনেক সময় তসলিমা বলে আমার মনে হয় না। আগের তসলিমা আর এই তসলিমাকে আমি মেলাতে পারি না। আমি তসলিমার মত দেখতেই শুধু, আর কিছু মিল দুজনের মধ্যে নেই। সেই সাহসী মেয়েটির ফাঁসি হয়ে গেছে, এখন ধুকধুক আত্মা নিয়ে বেঁচে আছে একটি ভীতু


Rx Munna

446 Блог сообщений

Комментарии

📲 Download our app for a better experience!