দেশান্তর – ৩

আগামীকাল এসে যায়। দিন পার হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। মা আমাকে পাঁচবেলা মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। যা যা খেতে ভালবাস??

আগামীকাল এসে যায়। দিন পার হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। মা আমাকে পাঁচবেলা মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। যা যা খেতে ভালবাসি, নিজে হাতে রান্না করেছেন। আমি খানিকটা অবসর পেতে চাই, দাদা আর বাবার রাজনীতির আলাপ থেকে সরে এসে একা হতে চাই। লেখার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই ভেতর থেকে। হাতে টিকিটটি নিয়ে বসি, এখন আমার হাতে সব ক্ষমতা। ইচ্ছে করলে এটি আমি এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারি। এখন আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি আমি কোথাও যাবো না। টিকিটটিকে নাড়াতে থাকি হাতে, দ্রুত, খুব দ্রুত। যেন হাতপাখা এটি। ছিঁড়বো কি ছিঁড়বো না অবস্থায় বার বার বলি নিজেকে, টিকিট হাতে আছে বলেই বুঝি যেতে হবে, ছিঁড়ে ফেললেই তো হয়, ছিঁড়ে ফেল, তুমি যেও না কোথাও, যেও না। কিন্তু অদৃশ্য কে যেন আমার দেশ ছাড়তে না চাওয়ার বাসনার কথা জেনে হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, —তুমি কেন থাকবে এ দেশে? তোমার এই বিপদের সময় কি তোমার বোঝা হয়নি কটি লোক তোমাকে সমর্থন করে! এখনও কি বোধ হয়নি! কী ভরসায় থাকবে এ দেশে!

 

—কেন আমাকে ভরসা করতেই হবে?

 

—করতেই হবে কারণ তোমাকে হত্যার জন্য লক্ষ লোকের জমায়েত হয় এই দেশে। ভরসা তো করেছিলে, লুকিয়ে যখন থেকেছিলে! তুমি কি ভেবেছো, জামিন পেয়েছো বলে তোমার সব সমস্যা এখন শেষ হয়ে গেছে! প্রতিদিন নানারকম বিপদের সামনে পড়তেই হবে তোমাকে, তখন কার ওপর ভরসা করবে?

 

—কেন, আমাকে যারা আশ্রয় দিল! তারা তো আমার পাশে দাঁড়িয়েছে! শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী.. আমাকে সমর্থন করেন।

 

—কজন? হাতে গোনো। হাতে গোনো, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, করে গোনা। হাতের কড়াগুলো তবুও তোমার বাকি থেকে যাবে, এ দেশে লোক আছে বারো কোটি। বারো কোটির মধ্যে কজন তোমার পক্ষে! কেন এ দেশে থাকবে তুমি! তোমার অভিমান হয় না! এ দেশে তুমি থাকতে চাও কেন?

 

—আমার আত্মীয়রা আছে। এরা আমাকে ভালবাসে।

 

—ভালবাসে ঠিক কথা। কিন্তু তাদের ভালবাসাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট! তুমি এখন সাধারণ একজন মানুষ নও যে, আত্মীয়দের ভালবাসা আর সমর্থন দিয়েই একশ একটা বিপদ থেকে তুমি রক্ষা পাবে। মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বাঁচবে। তোমার আত্মীয়রা খুব নিরীহ মানুষ। তাদের কোনও শক্তি নেই। তারা তোমার চেয়েও নিরীহ। বেঁচে থাকতে চাইলে চলে যাও, বেঁচে থাকলে তুমি লিখতে পারবে, জীবনে যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ পাবে।

 

—নাহয় হাইডিংএ থাকার সময় ডেসপারেটলি ভেবেওছিলাম বিদেশে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন এই যাওয়াটা, বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকাটা কি রকম যেন অদ্ভুত লাগছে। কোনও মানে হয় না। কেউ আমাকে ঠিক করে বলছেও না কবে ফিরবো।

 

—ফেরার কথা ভাবার সময় নেই। পরের কথা পরে ভেবো। আগে বাঁচো তো। মনে রেখো আজ যদি বিদেশিরা তোমাকে সাহায্য না করত, তুমি এ দেশে বেঁচে থাকতে পারতে না। তোমার এত সমর্থক এ দেশে হয়নি যে এ দেশে থাকার সাহস তুমি কর। ওই হাতে গোনা কজন দিয়ে কিছু হবে না। তোমার বন্ধুর চেয়ে শষনুর সংখ্যা অনেক বেশি। এক লক্ষ শষনু যদি থাকে, একজন তবে বন্ধু। এভাবে হিসেব করো। এ দেশে তুমি বাঁচার আশা কি করে করো! তোমার আত্মীয় স্বজনের কোনও ক্ষমতা নেই তোমাকে বাঁচাবার। ওরা তোমার আত্মীয় বলে ওদেরও বিপদ অনেক। তুমি চলে গিয়ে ওদেরও বাঁচাও।

 

—কিন্তু..

 

—কিন্তু কি!

 

—সময় তো জানি সব আবার ঠিক করে দেয়। হয়ত কদিন পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। প্রাণনাশের হুমকি কি আমার জীবনে এই প্রথম? সেই কবে থেকেই তো!

 

—না যাও। সরকার তোমাকে ঠেলে বের করবে। আজ না যাও, কাল যেতে হবে। কাল না যাও পরশু যেতেই হবে। এটা তোমার সিদ্ধান্ত নয়। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।

 

—এই সরকার তো আমার শষনু। এই সরকার কি আমাকে বাঁচাতে চাইছে!

 

—তোমাকে বাঁচাতে চাইছে না। নিজে বাঁচতে চাইছে। দেশের সরকার বিরোধী মৌলবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়ুক চাইছে, বিদেশের দুর্নাম বন্ধ করতে চাইছে।

 

—আমার কি অন্য কোনও উপায় নেই?

 

—না।

 

—কোনও উপায়ই নেই?

 

—না।

 

অনেকক্ষণ বসে থাকি একা একা। মাথা ঘোরে, ঘোরে আমার এই প্রিয় ঘরটির সবকিছু। লেখার টেবিল। চারপাশের বইভর্তি বইয়ের তাক। ঘোরে না শেষ করা বিস্তর লেখা, ঘোরে স্তূপ স্তূপ লেখার কাগজ, ঘোরে দেয়ালে টাঙানো আমার প্রিয় তেলচিত্রগুলো, ছবিগুলো, ঘোরে পুরস্কারের পদক, ঘোরে জানালার ভারী সবুজ পর্দা। এই ঘরে দিনের পর দিন কেটেছে আমার লেখায়, পড়ায়। এই ঘরটি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে! আমার সব তো এখানে। আমার জীবনটিই


Rx Munna

446 Blog Mesajları

Yorumlar