ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। রুদ্রনীল ঘোষ। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।। কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্য। সুমন ভট্টাচার্য। এরা শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তার মানে এই নয় এরা এই সমাজের মানুষ নয়। পুরুষ শাসিত সমাজের পুরুষ এরা। যে পুরুষেরা গান গায়, কবিতা লেখে, বাজনা বাজায়, অভিনয় করে — অর্থাৎ শিল্প সাহিত্য চর্চা করে, সেই পুরুষেরা, ভাবা হয় যে মানুষ হিসেবে বুঝি খুব উন্নত, মানবতায় বা মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, নারী স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। এটি একশ ভাগ ভুল একটি তথ্য। শিল্প সাহিত্যের বাইরের লোকদের মধ্যে যে পরিমাণ ভালোত্ব এবং মন্দত্ব আছে, ভেতরের লোকদের মধ্যে তা একই পরিমাণ আছে। গ্রামের একটি কৃষক-পুরুষ নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হতে পারে, একটি নামকরা নায়ক তাতে একবিন্দু বিশ্বাসী নাও হতে পারে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মধ্যেও নারী নির্যাতন প্রশ্নে কোনও দ্বিমত নেই। বরং শিক্ষিতদের মধ্যে দেখা যায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তুলনায় বেশি। এর কারণ, শিক্ষিতরা ভালো শিখতে পারে তন্ত্র মন্ত্র। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শিখে নিতে পারে নিয়ম কানুন, পুরুষতন্ত্রের পুঙ্খানুপঙ্খ। অশিক্ষিতদের পক্ষে এত শেখা সম্ভব হয় না।
পুরুষেরা যারা কৃষক, যারা শ্রমিক, ছোট চাকুরে, বড় চাকুরে, ব্যবসায়ী, উকিল, বিচারক, ডাক্তার, ইঙ্গিনিয়ার, বিত্তানী, শিল্পপতি, শিল্পী, সাহিত্যিক বা অন্য কিছু, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক — দেখা যায় তারা নারী নির্যাতনে প্রায় একইরকম সিদ্ধহস্ত। ধন যাদের যেরকমই থাকুক, এক সমাজেই তাদের বাস, সে সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষের নিয়মে, পুরুষের আধিপত্যে, পুরুষের বংশবৃদ্ধিতে যে সমাজটা চলে। শিক্ষিতরা নির্যাতন কিছু কম করে না। শিক্ষিত হলেই নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেবে, ভাবাটা ঠিক নয়। প্রচলিত যে শিক্ষা, ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাটা পাচ্ছে ছেলেমেয়েরা, তার সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনও বাক্য আমাদের ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে না কোনও বইয়ে। পাঠ্যপুস্তকে নারীর সমানাধিকারের পক্ষে কোনও জ্ঞান বিতরণের ব্যবস্থা নেই। প্রচলিত এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বড় হতে সবরকম সহযোগিতা করে। শিশুরা ঘরে বাইরে চোখ রেখে দেখে, শেখে, বোঝে, যে, নারীর স্থান গৃহে, সংসার পালনে, শিশু যত্নে, স্বামী সেবায়, এবং পুরুষের বাস বিশাল বিস্তৃত বহির্জগতে, বিদ্যায়, বিত্তানে, বৈভবে, বিপ্লবে, বিদ্রোহে, বিদ্বেষে, বিজয়ে। নারী বিদুষী হোক নিরক্ষর হোক, ধনী হোক দরিদ্র হোক, শহরে বা গ্রামে যেখানেই তার বাস হোক, পুরুষ শাসিত সমাজের নারীবিরোধী সংস্কৃতির সামনে সমান অসহায়।
এসব তথ্য কোনও মানুষের অজানা থাকার কথা নয়। বোধবুদ্ধি থাকলে কেউ এসব নিয়ে তর্ক করে না। কিন্তু কলকাতার কিছু লেখাপড়া জানা পুরুষ দেখলাম, বলছে, বধূ নির্যাতন এবং নারী নিগ্রহ আইন ভারতবর্ষের সবার জন্য মানানসই নয়। কেন নয় জিজ্ঞেস করায় খুব গম্ভীর কজ্ঞে একজন বললো, মুর্শিদাবাদের গ্রামের কোনও মেয়ের জন্য যে আইন খাটে, গড়িয়াহাটের বহুতল ফ্ল্যাটের মেয়ের জন্য সে আইন খাটে না। কেন খাটে না জানতে চাইলে যা বললো তা হল, যেভাবে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়, সে রকম অত্যাচার তো শহরের শিক্ষিত মেয়েদের ওপর হয় না। গ্রামের মেয়েদের মেরে আধমরা করে ফেলে রাখলেও কই ওরা তো মামলা করতে যাচ্ছে না, কিন্তু শহুরে শিক্ষিত মেয়েরা সামান্য মার খেলেই ফোর নাইনটি এইট দেখিয়ে দেয়। হাঁ হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। আমার ওই বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই গড়গড় করে বলে গেল, মেয়েরা খুব অপপ্রয়োগ করছে এই আইনের। এই আইন পুরুষবিরোধী আইন। মার খেলে মেয়েরা থানায় ডায়রি করতে পারে। কিন্তু ফোর নাইনটি এইট কেন? অনেক নিরপরাধ পুরুষকে এই আইন ব্যবহার করে হয়রানি করা হচ্ছে। শহরের লোকেরা এখন কাহিনী বুঝে গেছে। তাইতো ব্যাকল্যাশ হচ্ছে। রাগে পুরুষগুলোর চোখ জ্বলছিল। মেয়েদের