কলকাতায় বসবাস করার শুরুতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। সংসারের কাজে আমাকে সাহায্য করার জন্য তখন কাউকে চাই আমি। খুঁজছি কাকে পরিচারিকার চাকরিটি দেওয়া যায়। এক বন্ধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, ওখান থেকে দৌড়ে এসে বললো, ‘তোমার পাশের বাড়ির দিকে একটা বউ যাচ্ছে, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।’
আমি ঠিক বুঝে পেলাম না কী বলছে বন্ধুটি, বললাম, ‘কে যাচ্ছে বললে?’ বললো, ‘বউ।’
‘বিয়ে হচ্ছে নাকি পাশের বাড়িতে! বরকেও দেখলে?’
আমি বারান্দায় এলাম দেখতে কী ঘটছে। না, যেমন ছিল চারদিক, তেমনই আছে। কোনও বাড়িতে বাড়তি হৈ চৈ নেই, সানাই বাজছে না কোথাও। বর বধূ বেশে কাউকেই দেখলাম না উঠোনে। বন্ধুটি জোরে হাসছে তখন। এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখও নয় যে আমাকে বোকা বানাবে কেউ। কিন্তু টের পাই যে আমি বোকা বনে আছি।
না, একদিনে হয়নি। কয়েক মাস আমার লেগেছিল বুঝতে যে, যে মেয়েরা অন্যের বাড়ি কাজ করে, সে মেয়েরা যদি বিবাহিত হয়, তবে তাদের বউ বলে ডাকা হয়। এই মেয়েদের বর বা স্বামীর সঙ্গে কারও চেনা পরিচয় থাকতে হবে, তার কোনও মানে নেই।
‘আর যে পুরুষেরা অন্যের বাড়ি কাজ করে, তারা যদি বিবাহিত হয়, তবে কি তাদের বর বা স্বামী বলে ডাকা হয়?’
আমার এই প্রশ্নকে উদ্ভট বলে লোকেরা বিবেচনা করে। কিন্তু আমার প্রশ্ন অতি সরল, এবং সহজ। বুঝতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও কাউকে আমি বোঝাতে পারি না।
না। এই বউ বলে ডাকার চলটি একেবারে যে কথ্য ভাষায়, তা নয়। শুদ্ধ ভাষায় এর চল বেশ আছে। রাজ্যের পত্রিকাগুলোয় প্রায় প্রতিদিনই পড়ছি, ‘ঝাঁপ দিয়ে বধূর আত্মহত্যা।’ ‘বধূ খুন’। ‘বধূ ধর্ষণ’। বধূদের নিয়ে কিছু না কিছু খবর থাকেই। বধূ কারা? ওই একই উত্তর। মেয়ে। মেয়েদের বধূ বলা হচ্ছে কেন? যেহেতু তারা বিবাহিত। মেয়েরা কি বিয়ে করলে আর মেয়ে থাকে না? বধূ হয়ে যায়? পুরুষরা তো বিয়ের আগে এবং পরে পুরুষই থাকে। খবর কোনওদিন এরকম পড়িনি, বরের আত্মহত্যা। বর খুন। বর ধর্ষণ। বা ‘স্বামীর আত্মহত্যা’। ‘স্বামী খুন’। ‘স্বামী ধর্ষণ’। নাম দিয়ে নয়, লিঙ্গ দিয়েও নয় অর্থাৎ মেয়ে মহিলা নারী রমণী কিছু দিয়ে নয়, তার শিক্ষা দীক্ষা, কাজ কর্ম দিয়ে নয়, প্রতিভা পারদর্শিতা দিয়ে তো নয়ই, মেয়ের পরিচয় পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক দিয়ে।
বাজার করতে গেলে, যে মাছওয়ালারা আমাকে চেনে না, ডাকে বৌদি বলে। আমি যদি তাদের বৌদি, তবে তাদের দাদাটা কে, একদিন জানতে চেয়েছিলাম। না, কোনও দাদাকে তারা চেনে না। মহিলা দেখলেই গণহারে বৌদি ডাকে তারা। অভ্যেস। শুধু মাছওয়ালাকে দোষ দিই কেন, যত ওয়ালা আছে, সবাই ওই একই পথের পথিক। টেলিভিশনের রান্নাবান্নার অনুষ্ঠানে যে মহিলাই আসুক রান্না করতে, মধুর হেসে সবাইকেই বৌদি বলে সম্বোধন করা হয়। কোনও এক পুরুষ-দাদার বউ সে, এই হল মহিলার পরিচয়।
অভ্যেস। অভ্যেসটা না হওয়ার কোনও কারণ নেই বলে অভ্যেসটা হয়েছে। মানুষ তো তার পরিবার পরিজন থেকে, চারপাশের চারজন থেকে শেখে। তারা শিখেছে যে মেয়েদের সবসময় কোনও না কোনও পুরুষ-প্রভু থাকতে হয়, পুরুষ-প্রভুরা মেয়ে নামক প্রাণীগুলোর নিরাপত্তা। শিখেছে যে মেয়েদের পণ দিয়ে পুরুষ-প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে পরাশ্রয়ী লতার মতো বেঁচে থাকতে হয়। শিখেছে মেয়েদের কোনও পৃথক অস্তিত্ব থাকতে নেই।
সাধারণত স্বামীর ওপর সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মেয়েরা। তবে সত্য এই, মেয়েরা যতদিন না রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুরুষের সঙ্গে সমান হচ্ছে, ততদিন তাদের নিজের পরিচয়ে নিজের বাঁচাটা নিশ্চিতই দুরূহ। যতদিন না তারা শারীরিক স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততদিন তাদের মানসিক স্বাধীনতাও কচু পাতায় জলের মতো, এই থাকে তো এই থাকে না।
মেয়েরা কী করে নিজের পরিচয় নিজেই হবে যদি বিয়ে করলে নিজের বাড়ি তাকে ছাড়তে হয়, অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের করুণায় তাকে বাস করতে হয়, অন্যের ঠিকানাকে নিজের ঠিকানা করতে হয়, অন্যের নামকে নিজের নাম? মেয়েরা নিজে তখন নিজের আর পরিচয় নয়। স্বকীয়তা তো ওখানেই শেষ। অস্তিত্ব বা ব্যক্ততি্বের তো ওখানেই মৃত্যু।