স্যার আলফ্রেড বেনহার্ড নোবেল

স্যার আলফ্রেড বেনহার্ড নোবেল

জন্ম : ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু : ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ

স্যার আলফ্রেড বেনহার্ড নোবেল

 

জন্ম : ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ

মৃত্যু : ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ

 

সারাজীবন তিনি কখনও স্কুলে যাননি। স্কুলের ঘণ্টা কীরকম তাও শোনেননি। রিসেস বা টিফিনের সময় কেমনভাবে হই-হই করে খেলতে হয়, সেটা উপভোগ করার সৌভাগ্য কখনও হয়নি তাঁর। পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সোনার পদক গলায় ঝোলানো নাঃ, এই স্বপ্নটাও সফল হয়নি বেচারি নোবেল-এর।

 

অথচ, আজ তাঁর নামে নামাঙ্কিত পুরস্কার পাওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর বুদ্ধিজীবী মানুষ তৎপর হয়ে ওঠেন। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় নিয়মমতো পরিকল্পনা। যোগাযোগ করা হয় নোবেল কমিটির সঙ্গে। নানা ধরনের বাধানিষেধ পার হয়ে অবশেষে ১০ই ডিসেম্বর তারিখে দেওয়া হয় এই ঈপ্সিত পুরস্কার। ওই বিশেষ দিনটি যে তাঁর মৃত্যু দিন!

 

আজও আলফ্রেড নোবেল এভাবেই আমাদেরকে উজ্জীবিত করে চলেছেন। আমাদের কানে পৌঁছে দিয়েছেন সেই মন্ত্রমালা। তা হল—‘পুঁথিগত শিক্ষাই সাফল্য অর্জনের শেষ কথা নয়। যদি সত্যি সত্যি আমরা প্রতিভাসম্পন্ন হই, তাহলে একদিন সহস্র সূর্যের আলোয় তা আলোকিত হবেই: কেউ তাঁর পথ রুদ্ধ করতে পারবে না!

 

নোবেল-এর জন্ম হয়েছিল সুইডেনের রাজধানী স্টকহেলম শহরে। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২১শে অক্টোবর হল তাঁর জন্মদিন। মোটামুটি উচ্চবিত্ত পরিবারেই জন্মেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। বাবার নাম ইমানুয়েল নোবেল। তিনি এক বিশিষ্ট স্থপতি হিসেবে সমাজে প্রতিঠা অর্জন করেছিলেন। এর পাশাপাশি সকলে তাঁকে চিনত এক 'র্কি টই-গবেষক হিসেবে।

 

সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ইমানুয়েল। টর্পেডো আর মাইন নির্মাণের ব্যবসা ছিল তাঁর। মায়ের নাম ক্যারোলিনা। অসাধারণ বিদুষী মহিলা ছিলেন তিনি। অ্যালফ্রেড ছোটো থেকেই মাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন।

 

আলফ্রেডের যখন মাত্র চার বছর বয়স, তখন বাবা ইমানুয়েল এলেন ফিনল্যান্ডে। মায়ের সাথে আলফ্রেড রয়ে গেলেন সুইডেনের স্টকহেলমে। বাবা কাছে নেই, মা একাধারে বাবা ও মায়ের ভূমিকা পালন করছেন।

 

সে এক অদ্ভুত জীবন! সারাদিন কেটে যাচ্ছে মায়ের সান্নিধ্যে। মা কত গল্প শোনাচ্ছেন। রূপকথার গল্প, বিজ্ঞানের গল্প, আবিষ্কারের কাহিনী। শুনতে শুনতে চোখদুটি বড়ো বড়ো হয়ে উঠছে সেদিনের শিশু আলফ্রেড নোবেলের। পৃথিবীটা কত বড়ো! কী আছে তার শেষে? এমন কত প্রশ্ন জাগত তাঁর মনের মধ্যে।

 

ইমানুয়েল এলেন রাশিয়ার লেনিনগ্রাড শহরে। সেখানে গোলাবারুদের বিস্ফোরক তৈরির ব্যবসা শুরু করলেন। ন বছর বয়সে আলফ্রেডকেও লেনিনগ্রাডে চলে আসতে হয়েছিল। স্টকহেলম শহরকে চিরদিনের জন্যে গুডবাই জানিয়ে তিনি হলেন ভিনদেশের বাসিন্দা।

 

ইমানুয়েল ছিলেন অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না তাঁর। বরং বারেবারে তিনি এই শিক্ষার কুফল সম্পর্কে সকলকে ওয়াকিবহাল করতেন। কথায় কথায় বলতেন—‘তোমাদের এই বিদ্যালয়ের জন্য আমার মনে কোনো ভালোবাসা নেই। ওখানে মানুষ তৈরি হয় না। তৈরি হয় কতগুলো যন্ত্রদানব। আমার ছেলে আলফ্রেডকে আমি বাড়িতেই পড়াশোনা শেখাব।'

হা-হা করে হেসে উঠতেন পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরা। আত্মীয় স্বজনেরাও বারণ করেছিলেন। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে পড়াশোনা আবার হয় নাকি?

 

ইমানুয়েল কিন্তু কারও কথা শোনেননি। ভালো একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন আলফ্রেডের জন্য। তাঁর কাছে রসায়নবিদ্যাতে হাতেখড়ি হয়েছিল আলফ্রেডের। গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আলফ্রেডের শৈব শিক্ষা ভালোভাবে শেষ হয়েছিল। অল্প বয়স থেকেই তিনি একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে চলতেন। সময়ের এতটুকু এদিক-ওদিক করতেন না। ভোর হওয়ার আগেই তাঁর ঘুম ভেঙে যেত। সকালে উঠে বেশ কিছুক্ষণ প্রার্থনা করতেন। তারপর পড়ার টেবিলে বসতেন। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ পড়তে ভালোবাসতেন আলফ্রেড নোবেল। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নের মধ্যে কেউ কোথাও নেই। আছে শুধু দিগন্তবিস্তৃত মাঠ এবং আকাশের চাঁদের আলো। আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারতেন, এই বাঁধাধরা জীবন থেকে তাঁকে মুক্তি নিতে হবে, আজ অথবা আগামীকাল।

 

জীবনে কতকগুলো নীতিকে ভীষণভাবে মেনে চলেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। কখনও ধূমপান করেননি। বন্ধুদের সঙ্গে হই হুল্লোড়ে মাতেননি। একমনে বই পড়তে ভালোবাসতেন। ভালো লাগত হার্বাট স্পেনসারের দর্শন। ভলতেয়ার-এর রাষ্ট্রচিন্তা তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করত। আর ভালোবাসতেন শেক্সপিয়ারের নাটক গড়তে।

কিশোর বয়সে আলফ্রেডের মনে কবিতার পোকা ঢুকেছিল। সেই বয়সে তিনি বেশ কয়েকটা প্রেমের গানও লিখে ফেলেছিলেন। নিজেই সুর দিয়েছিলেন। গুনগুন করে গান গাইতেন তিনি। দেখা গেল, অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বেশ কিছু অনুরাগীও জন্মেছে।

 

এরই পাশাপাশি নাটক, গল্প আর উপন্যাস লিখতে থাকেন। পরে অবশ্য ওই সৃজনপ্রতিভা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। তখন আলফ্রেড কেবল রসায়নের এক যুগ্ধ গবেষক।

 

আলফ্রেড নোবেল পরবর্তীকালে ডিনামাইট আবিষ্কার করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন। শেষ জীবনে অর্থের প্রতি কেমন যেন একটা নির্লিপ্তির ভাব জেগেছিল তাঁর মনে। নিজের লাভ অপেক্ষা কারখানার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাই তাঁর কাছে বড়ো হয়ে দাঁড়াল। তিনি শ্রমিকদের জন্যে অনেক উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সৃজনমূলক কর্মোদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্যেও তিনি সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। ১৮৯৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর তিনি নিজের হাতে এক ঐতিহাসিক উইল তৈরি করে ৯০ লক্ষ ডলার মূল্যের একটি অর্থ তহবিল গঠন করে স্বদেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে জনা দেন। উইলে তিনি লেখেন আমার সমস্ত অর্থ যা এতদিন পর্যন্ত অছি কর্তৃক নিরাপত্তার সঙ্গে রক্ষা করা হয়েছে, সেই অর্থ দিয়ে একখানা তহবিল গঠন করতে হবে। তারপর জমানো সে অর্থের যে সুদ গৃহীত হবে সে অর্থ দিয়ে আগের বছর মানব কল্যাণের জন্য যারা অবদান রেখেছেন তাদেরকে পুরষ্কৃত করা হবে। সুদের অর্থ মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, রসায়ন, শান্তি, সাহিত্য এই সমস্ত বিষয়ে কৃতী ব্যক্তিদের তা দেওয়া হবে। পুরস্কারগুলি দেওয়ার সময় পুরষ্কৃত ব্যক্তি কোন্ দেশের এটা যেন কখনই বিবেচনার মধ্যে না রাখা হয়। এই আমার আন্তরিক ইচ্ছে।

 

উইল তৈরি করবার এক মাস তেরো দিন পর তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেন। সময়টা ১৮৯৬ সালের ১০ই ডিসেম্বর। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯০১ সালে তারই নামে তার দেশের সরকার কমিটি গঠন করে নোবেল পুরস্কার চালু করেন। এমনকি তার মৃত্যুদিনেই প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার মনোনীত কৃতী ব্যক্তিদের প্রদান করা হয়।

 

ইতিহাসখ্যাত এমন অমরকীর্তি রচনা করে নোবেল শুধু বৈজ্ঞানিক হিসেবেই নাম পেলেন না একজন মহান, মানবপ্রেমিক, শা

ন্তকামী দূত হিসেবেও অমর হয়ে রইলেন।


ALEX SAJJAD

82 Blogg inlägg

Kommentarer