কিশোর অপরাধ

আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। পরিবার কাঠামো??

কিশোর অপরাধী কারাঃ কিশোর অপরাধী হলো সেই সকল কিশোর কিশোরী যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজ বিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে ১৪ বছরের, ফিলিপাইনে ৯ বছরের এবং ভারত, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে ৭ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রদান না করে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়।- যথাসময়ে কিশোররা সংশোধন না হলে কালক্রমে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে।

 

 

 

কিশোর অপরাধের ধরণ ও প্রকৃতিঃ সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি। বাংলাদেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় কিশোর অপরাধ বা অপরাধীকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় যেমন-

 

 

 

 

১। শহর এলাকার কিশোর অপরাধী ২। গ্রাম এলাকার কিশোর অপরাধী ৩। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী ৪। উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী।

 

 

 

 

আর এ সকল কিশোর অপরাধীদের মধ্যে প্রধানত যেসব অপরাধ লক্ষ্য করা যায় তা হলো- জুয়া খেলা; নেশা করা; খেলার মাঠ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি; বাস, ট্রেন ও সিনেমা হলে বিনা টিকিটে যাওয়া, পরীক্ষায় নকল করা, এসিড নিক্ষেপ, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, মারপিট, অন্যের বাগানের বা ক্ষেত্রের ফল ও ফসল চুরিকিশোর অপরাধের কারণঃ শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী সমাজের মতো বর্তমানে স্বল্পোন্নত সমাজেও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বাড়লেও সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে বিদ্যমান, হতাশা, নৈরাজ্য আর দারিদ্র্য কিশোর অপরাধ সৃষ্টির প্রধান কারণ। শহরের দূষিত পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন ও অশিক্ষা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য কিশোরদের চুরি, ছিনতাই, পকেটমারের মতো অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করে। মূলত সামগ্রিকভাবে কিশোর অপরাধের প্রধান কারণগুলো হলো- ভগ্ন পরিবার ও পিতামাতার দাম্পত্য কলহ যেখানে আবেগ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে চরম দারিদ্র্য ও পিতামাতার অবহেলা শিশুশ্রম ও জোরপূর্বক শিশুকে কাজে বাধ্য করা খারাপ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করা, পারিবারিক অস্থিতিশীলতা ও অসম্প্রীতি, পিতা বা মাতার পুনর্বিবাহ, মা কর্মজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত শিশুযত্নের অভাব, অতিরিক্ত শাসন, রক্ষণশীলতা ও বাবা-মার পরস্পরবিরোধী মানসিকতা, স্বার্থপর ও ফন্দিবাজ রাজনীতিবিদ কর্তৃক কিশোরদের পিকেটিং-এ ব্যবহার, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি।

 

 

 

 

সমাজ জীবনে কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাবঃ আজকের কিশোর কিশোরীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই কিশোর অপরাধের প্রবণতা দেশ, জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। কিশোর অপরাধের প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। শিশু কিশোর দ্বারা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পকেটমারের মতো অপরাধ জনগণের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। ছাত্রী অপহরণ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি কারণে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের কারণে সমাজে মাদকাসক্তি ও যৌনাচার বেড়ে চলেছে যা সমাজ জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া কিশোরদের দ্বারা পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অবাধ্যতা, অশোভন আচরণ, পারিবারিক জীবনে শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি কিশোরদের অর্থবহ জীবনকে ধ্বংস করে জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিবাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনমূলক কার্যক্রমঃ বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান আছে। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালে ঢাকায় Brostal School প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে কিশোর আদালত এবং টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এ ছাড়া কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য কিশোর হাজত, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রবেশন, প্যারোলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে অপরাধী কিশোরদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিশোরদের সংশোধনের ব্যবস্থা করাই এ সকল কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।

 

 

 

 

কিশোর অপরাধ মোকাবিলার সম্ভাব্য উপায়ঃ কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে আমাদের সকলের উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কিশোররাই দায়ী নয়। এজন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। তাই সরকারি প্রচেষ্টা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-

 

 

 

 

- কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

 

- কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যত্নবান হতে হবে।

 

 

 

- সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু কিশোরদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

 

 

- শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে পিতামাতাকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানের ভালোলাগার ও মন্দলাগাকে বিচার করতে হবে।

 

 

 

- কিশোরের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য গঠনমূলক পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

 

 

 

- দেশে পর্যাপ্ত কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

 

 

 

- স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।

 

 

 

উপসংহারঃ কৈশোরকাল মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের সময়। এ সময় থেকেই মানুষ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে শুরু করে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে অকালেই সে আশাহত হয়। হতাশা আর নৈরাজ্য জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। কিশোরের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্গুরে বিনষ্ট হওয়ায় তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই যে সকল বহুমুখী কারণে কিশোর অপরাধের সৃষ্টি তা রোধ করতে হবে। আমাদের বর্তমান কিশোরদের প্রকৃত মানুষ ও নিরপরাধী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জাতির উন্নতি সম্ভব।চ্ছে। করা ইত্যাদি।


rony3344

32 Blog postovi

Komentari