ভূতের গল্প

যেখানে আছে রয়েছি ওখানে আত্মা। চট্টগ্রামে কলোনিতে আগুনে এক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি যেন আমাদের মাঝে

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। থাকি নিলফামারীর অফিসার্স কোয়ার্টারে। সম্প্রতি অনেক আন্দোলন ধর্মঘট করে ৮ গিয়ারের একটা রেসিং সাইকেল আদায় করেছি বাসা থেকে। তো সারাদিন সেই সাইকেলে নিয়েই এদিক সেদিক টু টু করে ঘুরে বেড়াই স্কুল ফাঁকি দিয়ে। সাথে আমাদের কোয়ার্টারের, এবং ক্লাসের আরও কিছু ছেলেপুলে নিয়ে বেশ বড় একটা সাইকেল গ্রুপ থাকে বলা যায়।

 

নিলফামারী ছোট এক শহর। আমাদের কাজ হচ্ছে দল বেঁধে সাইকেল নিয়ে এই শহরের গন্ডী পার হয়ে অপরিচিত গ্রাম্য পথে দূরে কোথাও সারা দিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া। নিয়ম হচ্ছে যেই রাস্তা দিয়ে যাব, সেই রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতে পারবো না। অন্য নতুন কোন রাস্তা খুঁজে সেটা দিয়ে ফিরতে হবে।

 

তেমনি একদিন দুপুর বেলা স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেলাম নিরুদ্দেশ যাত্রায়। সাথে সুমন, ম্যাকগাইভার (মিলন), এবং আরও একজন (তার নাম সম্ভবতঃ বাবুল বা বাবলা টাইপের কিছু একটা ছিলো)। ক্যান্টিন ভরা পানি, এবং হালকা পাতলা কিছু নাস্তাও নিলাম সাথে। চারজন মিলে ঠাট্টাতামাশা করতে করতে পুরানো ডাকবাংলো পার হয়ে বড় গোরাস্তানটা ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে থামলাম। এখান থেকেই তিনটি মাটির রাস্তা বাঁক নিয়ে তিনদিকে চলে গেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা রাস্তা বেছে নিয়ে রওয়ানা হলাম আমরা।

 

রাস্তাটা উলটো দিকে ঘুরে গোরস্তানের আরেক পাশ দিয়ে অনেকদূর গিয়ে তারপরে আবার ডানে বাঁক নিয়েছে। তখন একেবারে ভর দুপুর। আশেপাশে তেমন কোন লোকজন নেই। চারদিকে কেমন যেন নিথর নিস্তব্ধ একটা ভাব। খুব একটা বাতাস পর্যন্ত নেই। গোরস্তানের গাছগুলো পর্যন্ত সব থম মেরে আছে কোন এক না জানা কারনে। তারই মাঝে গাছের পাতাগুলো যখন সরসর করে শব্দ করছিলো, মনে হচ্ছিলো সেখানে বসে অনেকেই যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে।

 

পরিবেশের প্রভাব বলে একটা কথা আছে। আমরা চারজনেই কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলাম। কিন্তু গোরস্তানের সীমানা পার হয়ে আসতেই দেখা গেলো যে আবার গল্পে মগ্ন হয়ে গেলাম সবাই মিলে। তবে এবার গল্পের বিষয় হচ্ছে গোরস্তানের বিভীষিকা। ম্যাকগাইভার এই এলাকারই আদিসন্তান। ওর কাছ থেকেই শুনতে লাগলাম এই গোরস্তানের বিভিন্ন ভয়ংকর সব গল্প। এই গোরস্তানের নাকি মানুষের মাংস খাবার প্রচন্ড ক্ষুধা রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে কোন লাশ কবর না দিলে নাকি আশেপাশে কোন জীবিত মানুষ পেলে তাকেই টেনে নিয়ে যায় এই গোরস্তান। এবং সেই মানুষটাকে পরে মৃত এবং অর্ধেক মাটি চাপা অবস্থায় পাওয়া যায় পরদিন। এজন্যেই সন্ধ্যার পর থেকে পারতপক্ষে কেউ এই রাস্তা মাড়ায় না আর। এছাড়া আরও অনেক রকম গল্প আছে এই গোরস্তানকে কেন্দ্র করে। অমাবস্যা এবং পূর্ণিমাতে নাকি সেখানে মৃতদের উৎসব বসে। সেই উৎসবে নাকি তারা একজন জীবিতকে ধরে আনে উৎসবের মধ্যমনি হিসাবে। এই গোরস্তানে যতোগুল কাক বাস করে, সেগুলো নাকি আসলে পাখি না। মৃতদের আত্মা। সেই পাখিও যদি কারও দিকে তাকিয়ে ডাকে, তবে যতোবার ডাকে তার আয়ুও নাকি আর ততোদিনই থাকে। তারপরে এই গোরস্তানেই হয় তার শেষ কবর।

 

যাই হোক, এসব গল্প শুনতে শুনতে এক সময় আমরা এগুলো নিয়ে ঠাট্টা তামাশাও শুরু করে দিলাম। ভুতের সাথে দেখা হলে কি হবে, তাকে কিভাবে নাজেহাল করবো তাই নিয়ে শুরু হয়ে গেলো আমাদের একেক জনের কম্পিটিশন। আমি মনে মনে একটু ভীতু টাইপের ছিলাম বলেই হয়তো আমার কৌতুকই বরং অন্যদের থেকে একটু বেশি ছিলো। যেহেতু জানি যে এই রাস্তা দিয়ে আর ফিরতে হবে না, তাই গোরস্তানে আমি কতোবার ঢুকতে পারি আর বের হতে পারি, কতো ভুতকে কতোভাবে বশ করলাম সেসব গল্পই বলতে লাগলাম বুক ফুলিয়ে। বলা যায় এভাবে হাসির মাধ্যমেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম সবাই মিলে। এবং একসময় সব ভুলে মগ্ন হয়ে গেলাম আমাদের সাইকেল ভ্রমনের আনন্দে। নতুন নতুন গ্রাম, এবং গ্রামের লোকজন দেখার মজাই আলাদা।

 

কিন্তু তখনও জানতাম না যে আজ এই দিনটাই সারা জীবনের জন্যে আমার স্মৃতিতে কি ভয়ংকর এক কালো রেখা হিসাবে দাগ কেটে থাকবে।


Tanvir Tanvir Farhan

86 Blog posts

Comments

📲 Download our app for a better experience!