#মন_পাঁজরে_তুই
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্বঃ ০৬
তাও মেয়েকে স্কুলে যেতে দিলেন না নীলিমা হক, কত-ই বা বয়স ওর এখনো ছেলেমানুষ সে কি আর এতো কিছু বুঝে।
শামসুল হক ও নীলিমা হকের দুই ছেলে মেয়ে নিয়েই তাদের সংসার ছেলে আদি বাংলা বিভাগ নিয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছে বয়স ২২, আর আবিরা দশম শ্রেণির ছাত্রী বয়স ১৬, দেখার বেলা পরিপূর্ণ গুণের বেলা শূন্য, সারাদিন পিকুকে নিয়ে বাসার এক কোণে পড়ে থাকে সে। বোনকে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার দায়িত্ব আদির, এ নিয়ে বন্ধুরা তাকে কম ক্ষ্যাপায় নি, গত ছ'মাস ধরে আবিরার পেছনে পড়ে আছে আবইয়াজ।
বিয়ের কথা নিয়ে বহুবার দাঁড়িয়েছে নীলিমা হকের সামনে কিন্তু কিছু বলার আগেই সব সময় তাকে ঝাপটে ধরেছে আদি।
মজা ভেবে সব সময় কথাগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে সে।
মায়ের উপর রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো আবিরা।
আজ বান্ধবী মিতুর জন্মদিন ছিলো, ক্লাসে নিশ্চয়ই কেক কাটাকাটি হবে, ইশ কি ভাগ্য আমার সবাই উপস্থিত থাকবে শুধু আমি ছাড়া।
ড্রয়িংরুমে রাখা একুরিয়াম'টা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে সুভাষিণী, এরকম গ্লাসের ভেতর রঙিন মাছ সে আগে কখনো দেখে নি।
আচ্ছা এগুলো কি সত্যি সত্যি মাছ? হাত দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
কিন্তু হাত দেওয়াটা কি ঠিক হবে।
মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো আওড়াতে লাগলো সুভাষিণী।
-সুভা।
আকস্মিক কারো ডাকে পেছন ফিরে তাকালো সুভাষিণী।
সেই সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, যার জন্য এবাড়িতে ঠাই হয়েছে তার।
হাতে আবার একটা ব্যাগ ও দেখা যাচ্ছে, কি আছে ওই ব্যাগে?
ইশ এই সুপুরুষের নাম-টাই তো জানা হয় নি।
ফাইয়াজ ব্যাগটি সুভাষিণীর দিকে এগিয়ে দিলো।
সুভাষিণী আমতা আমতা করে নিজের হাত গুটিয়ে নিলো।
-কি হলো নাও।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ'টা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো সুভাষিণী।
মিনিট দু এক নিরবতায় কাটলো দুজনের।
অতঃপর ফাইয়াজ বলে উঠলো কেউ কিছু দিলে ধন্যবাদ দিতে হয় এটাও জানো না?
সুভাষিণী থমথমে চেহারা নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ধন্যবাদ জানালো।
জামা দুটো কিন্তু আমার পছন্দের পড়ে দেখো তোমাকে মানাবে ভালো।
মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো সুভাষিণী।
ওই মেয়েটার সাথে কিসের এতো কথা বলছো ফাইয়াজ?
রাজিয়া খাঁনের কথায় ঘাড় ঘুরালো ফাইয়াজ।
-এই যে তার জামাগুলো দিতে এলাম।
ফাইয়াজের উত্তর মোটেও স্বাভাবিক ঠেকলো না রাজিয়া খাঁনের সহিত।
সাধারণ দুইটা জামা দিতে এতো টাইম লাগে?
মায়ের কথার উত্তর দিলো না ফাইয়াজ।
-সুভা ড্রেস চেঞ্জ করে আমার রুমে এক কাপ কফি নিয়ে আসো তো বলেই নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো ফাইয়াজ।
পেছন থেকে আবারও রাজিয়া খাঁন ডেকে উঠলেন?
-ওয়েট ওয়েট, তুমি ওকে কি নামে ডাকলে? সুভা! বাট হোয়াই?
-সুভাষিণী নাম'টা অনেক লম্বা ডাকতে বোরিং লাগে তাই ছোট করে ডাকলাম।
হাফ ছেড়ে বাঁচলেন রাজিয়া খাঁন এখনকার এইসব ছেলেদের ও না মতিগতি বুঝা দায়।
বিয়ের উপযুক্ত দুটো ছেলে বাসায় থাকায় কোনো কাজের মেয়ে বাড়িতে রাখেন না তিনি, বলা তো আর যায় না কখন কার ঘাড়ে শয়তান চেপে বসে, কিন্তু কি আর করার দেখো কাল আহনাফ এই উটকো ঝামেলা কোথা থেকে যোগাড় করে নিয়ে এসেছে, অবশ্য এই মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে থাকা যাবে, কালো কুচকুচে যা চেহারে তাতে কোনো ছেলের রুচিতেই আসবে না, ও হে বাড়িতে কাজের মেয়ে নেই বললে ভুল হবে একজন আছেন তবে উনি মেয়ে নয় কাজের মাসি বয়স চল্লিশ উর্ধ্বে তার একটি মাত্র ছেলে নাম আশফাক, সবাই তাকে আশফাকের আম্মা বলেই ডাকেন।
জামা পরিবর্তন করে রান্নাঘরে গেলো সুভাষিণী।
কফি দেখতে কেমন হয়? কিভাবে বানায় এটা আর কিভাবেই বা খায়! গ্রামে তো এই নাম তেমন একটা শুনেছি বলে মনে হয় না।
যাইহোক বাবা বড়লোকের ব্যাপার স্যাপার।
-সুভাষিণী মুখ কাচুমাচু করে বললো আশফাকের আম্মা আমাকে একটু কফি বানানো শিখাবেন?
-কেনো?
-বড় সাহেবের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন।
ভদ্রমহিলা সুভাষিণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, শান্তস্বরে বললেন তুমি এতো চিন্তা করো না। তুমি আমার মেয়ের মতো আমি তোমাকে বাড়ির সব কাজ একদম হাতে ধরে শিখিয়ে দেবো।
আশফাকের আম্মার কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সুভাষিণী।
এ বাড়িতে আসার পর থেকে নিজেকে বড্ড একা একা লাগে, বুকের মধ্যে কষ্টের পাহাড় যেনো দ্বিগুণ হারে বেড়েই চলেছে, যাক কেউ একজন তো পেলো যার সাথে বিনা সংকোচে মন খুলে দুটো কথা বলা যাবে।
কথা বলতে বলতে এক কাপ কফি বানিয়ে সুভাষিণীর হাতে দিলেন আশফাকের আম্মা।
কফি কাপ হাতে নিয়ে ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুভাষিণী।
সুভাষিণীর এমন থমথমে চেহারা দেখে হেসে দিলো ফাইয়াজ।
"সুভা তুমি এমনভাবে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছো যে দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই একটা খুন করে এলে।"
সুভাষিণী আমতা আমতা করে কফি কাপ ফাইয়াজের দিকে এগিয়ে দিলো।
ফাইয়াজ কাপটি হাতে নিতে নিতে বললো রাতে আসবো।
ফাইয়াজের কথা শুনে অজানা এক ভয়ে আৎকে উঠে সুভা।
রাতে আসবে মানে উনি কি বুঝাতে চাইছেন? উনি আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না তো? কিছুই তো নেই আমার এই শরীর ছাড়া, গরীবের ধন না থাকুক আত্মসম্মান টুকু আছে।
আমি কি আমার সতীত্ব বিলিয়ে দেবো তার কাছে? তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে সবাইকে মুখ দেখাবো কি করে।
চোখের কোণ ঝাপসা হয়ে এলো সুভা'র, আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে এই দুনিয়ার মানুষ বড়ই স্বার্থপর, স্বার্থ ছাড়া কেউ কাছে আসে না।
-কি হলো সুভা দাঁড়িয়ে রইলে যে?
ফাইয়াজের প্রশ্নের কোনো প্রতিউত্তর না করে বেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে এক কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সুভা।
-এ বাড়িতে থাকা আমার জন্য নিরাপদ নয়, যেভাবেই হোক এবাড়ি থেকে পালাতে হবে আমায়। আশফাকের আম্মা উনি কেনো এই বাড়ির লোকদের সম্পর্কে আমায় কিছু বললেন না।
আমি তো দেখতে কালো খাটো,নাক বোচা বড় সাহেব কেনো আমাকেই ভোগ্যপণ্য হিসেবে বেছে নিবে?
তবে কি শারীরিক মিলন মানুষের রুচিকেও নিচে নামিয়ে ফেলে? হবে হয়তো! নাহলে উনি কেনো আমার মতো কুৎসিত মেয়ের সাথে রাত কাটাতে চাইবেন।
মাথা ঝিম ধরে গেছে সারা শরীর অসার হয়ে আসছে সুভার, আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।
মাথায় শুধু একটা চিন্তা-ই ঘুরপাক খাচ্ছে যেভাবেই হোক নিজেকে বাঁচাতে হবে। যদি আজ আমার সতিত্ব হরণ হয় তবে আমি আত্মঘাতী হবো।
সকাল দশটা বাজে এখনো আদি দরজা খুলে নি।
-আদি আর কত বউ নিয়া ঘুমাবি এবার দরজা খোল ভাই।
আবইয়াজের ডাকে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খোলে দিলো আদি।
-শান্তিতে কি ঘুমাতেও দিবি না ভাই আমার?
-আর কত ঘুমাবি? ১০ টা বাজে সারারাত কি করেছিস একটুও কি ঘুমাস নি?(আবইয়াজ)
-আহ আবইয়াজ তুইও না, কাল কি ওর জন্য ঘুমানোর রাত ছিলো।(রাকিব)
খাটের এক কোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মোমো।
-বাহ এক রাতেই ভাবির চেহারা কেমন গ্লো করছে।(রাকিব)
-নির্লজ্জ এটা তোর প্রেমিকার বড় বোন হয়।(আদি)
-অন্যদিকে ফ্রেন্ড এর ও বউ হয় এটাও মাথায় রাখিস।
-বাসর তো একা একা করলি ব্যাপার না কিন্তু তোর মা যে সকালেই যেতে বলছে তোকে এই কথা কি মাথায় আছে?
আবইয়াজের কথা জিহবায় কামড় দিলো আদি।
আজকে আমি শেষ আবইয়াজ, আবিরার স্কুলের সময় শেষ দেখছি।
-ভালোই হইছে! কত করে বললাম আর কত বডিগার্ড এর চাকরি করবি এবার তোর চাকরিটা আমাকে দিয়ে দে, তখন তো শুনিস না এখন কেলানি খা।(আবইয়াজ)
-তাড়াতাড়ি চল ভাই।
-তোর বউ কি করবি?(রিফাত)
-আপাতত দুইদিন এখানে থাকুক পড়ে নাহয় ঝুপ বুঝে কোপ দিবো।
আচ্ছা ওয়েট আমি এক্ষুনি আসছি বলেই বেড়িয়ে পড়লো আদি।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে রুমে ফিরে এলো হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে।
মোমো'র হাতে ব্যাগ গুলো দিয়ে বললো, এখানে টুকিটাকি তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস আছে দেখে নিও, আপাতত এগুলো দিয়ে কষ্ট করে ম্যানেজ করে নিও।পরে একদিন সময় করে তোমাকে নাহয় মার্কেটে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ একটা প্যাকেটে খাবার আছে খেয়ে নিও, বিকেলে আমি আবার আসবো।
মোমো মাথা নাড়ালো।
-একেই বলে স্লা হারামি। কাল থেকে কত খাটলাম তার জন্য একবার মুখ দিয়ে বললো ও না তোরা কি খেয়েছিস, নিজের বউয়ের জন্য ঠিকই পার্সেল করে নিয়ে এসেছে, এক রাতে এতো ভালোবাসা।
রাকিবের কথায় ক্ষিপ্ত হলো আদি।
-তো বউকে ভালোবাসবো না তো কাকে বাসবো? বিয়ে করাইছস কেন তোরা আমায়?
-ভাই তুই যাবি? এমনিতেই তোকে আমি নিজের জিম্মায় রেখেছি, তারমধ্যে আবার বাড়ি যেতে দেরি করছিস তোর মা তোকে রেখে আমাকেই না আবার কেলানি দেয়।(আবইয়াজ)
-হ্যা তোরা যা আমি আসছি।
সবাই নিচে গিয়ে আদির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
আদি মোমো'র কপালে নিজের ওষ্ঠ জোড়া ছুইয়ে দিলো।
-মন খারাপ করো না লক্ষীটি, আমি আবার আসবো, নিজের খেয়াল নিও আর হ্যাঁ কোনো সমস্যা হলে বা কিছুর প্রয়োজন হলে সাথে সাথে আমাকে কল করো আমি চলে আসবো।
অস্পষ্ট হাসলো মোমো।
নিচে নেমে এলো আদি।
-স্লা বউকে এভাবে একা রেখে যেতে মন চাইছে না আবইয়াজ, ভালো একটা বুদ্ধি বের কর তাড়াতাড়ি কিভাবে মোমো'কে আম্মুর সামনে নিয়ে যাওয়া যায়।
-জীবনে অনেক বউ ভক্ত দেখছি তবে তোর মতো এমন চামচা জীবনেও দেখিনি।(আবইয়াজ)
-একবার শুধু তুই বিয়ে কর তখন দেখবো তুই কি করিস।(আদি)
-আমি আমার বউয়ের কথা শুনবো, বউ উঠতে বললে উঠবো, বসতে বললে বসবো আর শুইতে বললে শুইবো।
-আহা চান্দু লাইনে আসছো। নিজের বেলা ষোল আনা আর আমার বেলা এক আনাও না।
-তোর আর আমার মধ্যে অনেক পার্থক্য বুঝছস? আমি বিয়ে করলে প্রেম করে করবো তোর মতো হুট করে বিয়ে করে ধড়াম করে বউ ভক্ত হবো না।
-বুঝি বুঝি সব বুঝি, এবার চল।
-সাদিন রিফাত রাকিব তোরাও বাড়ি যা ভাই কাল রাতে তো একটুও ঘুমাস নি, তোরা বাড়ি যা আমিও আদিকে তার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবো।
রিফাত রাকিব সাদিন একটা বাইকে করে চলে গেলো, অন্য বাইকে আদি পেছনে বসে ও আবইয়াজ সামনে।
বাইক ৮০ তে ছেড়ে দিলো আবইয়াজ।
-ভাই আস্তে চালা।
-দামড়া বেডা হয়েও কি ভস পাস মাদ্রিদ?
-সদ্য বিয়ে করেছি এখনো কত কিছু করা,দেখা বাকী এখন মরে গেলে হয় নাকি? তাই ভয় তো একটু পাবোই।
আদির কথায় হেসে উঠলো আবইয়াজ।
বাইকটি গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো বাসার নিচে।
বাইক থেকে নেমেই দেখতে পেলো পিকু দাঁড়িয়ে আছে।
দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো পিকুকে।
-তোর পালিত মায়ের সাথে আমার চক্কর চলে, সেইদিক থেকে আমি তোর পালিত বাপ হই, আব্বা ডাক।
কুকুরটি মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো কোল নামার জন্য।
আবইয়াজ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,"আব্বা ডাকতে বলছি।"
কুকুরটি ঘেউঘেউ করে উঠলো।
-ডাকছে ডাকছে, আব্বা ডাকছে, এই আদি শুনছস আবিরার কুত্তা আমারে আব্বা ডাকছে নিজের বাপ বলে স্বীকৃতি দিছে।
এবার হাত আলগা করে দিলো আবইয়াজ, কুকুরটি কোল থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেলো।
-দেখছস আদি আমার হবু পোলা কত বেয়াদ্দব, বাপ চিনে না। যেই না হাত আলগা করছি ওমনি দৌড়ে পালাই গেছে, ওর মারে বলিস তো একটু শাসন করতে।
চলবে.....