আশ্বিন মাস

লেখক :আজিজুর রহমান

আশ্বিন মাস

 

আশ্বিন মাস বর্ষার পানি খাল বিলে কমতে শুরু করছে। ফসল ভরা মাঠ, কৃষকের স্বপ্ন যেন বাতাসে

দোল খাচ্ছে। সময়ের ফিড়িতে কেউ বসে নেই, উঠানে গবর দিয়ে লেপ দিচ্ছে কৃষানী ফসল ঘরে তোলার আঘাম প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতি গৃহস্থালী বাড়িতে।

শীত আসতে বেশ দেরী তবু ও ঘাসের ডগাই শিশির বৃন্দ লেগে সূর্যের আলোতে চিকমিক করে সোনালী সকাল বলে তাকে । বকুলের পাতা ঘেসে নতুন কুড়ি

উকি দিয়ে স্বাগতম জানায় নতুন দিনের পথে। 

শিশির ভিজা দূর্বাশত দলে খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা।

তারপর ও গ্রামের মানুষদে স্বপ্ন গুলো কখনই পুরুন হয় না কেন, তা আমার জানা নেই।

আকাশ কালো হয়ে মেঘ সাজলো সন্ধ্যা কালে, প্রচুর বাতাস বইছে সাথে বৃষ্টি, পদ্মা নদী যেন মাতাল হয়ে উঠলো। ভাঙ্গনের খেলায় মেতে উঠলো পদ্মা।

চারিধার কান্নার আহাঝারী বিভিসীকার মত তছনছ

করে ফেললো কূল ঘেষা গ্রাম খানিতে। অনেকেই গরু ছাগল নিয়ে কোন রকম প্রান নিয়ে ঘর বাড়ী ফেলে পাশের গাঁয়ে আশ্রয় নিলো। 

       কিছু দিন পুর্বে নবনীতা এক বার আসিয়া ছিল আমাদের উঠনে। যে আম গাছটির তলে তুমি বসে ছিলে নবনীতার সাথে। ঠিক ওইখানেই বসে

অনেক ক্ষন কেঁদে ছিলো । 

বলেছিল তুমি তো মায়ের মত বলতে গেলে মা'ই তাই তোমার কাছে মিথ্যা বলা মুসকিল,

আমি বলতে পারবো না কাকিমা। আমাদের এখান কার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে ওপার বাংলা নদিয়া 

জায়গা রেখেছে। বাড়ি করা হয়ে গেছে দু বছর। বিঘা দশেক ফসলী জমি রাখা আছে । কখন যেন আমরা চলে যাই।

সেদিন কোন শান্তনা নবনীতাকে আমি দিতে পারিনি।

শুধু বলেছিলাম সোনা না পুড়িে খাঁটি হয় না আর না কাঁদিলে ভাল বাসা খাঁটি হয় না নবনীতা।

সে দিন নবনীতার সাথে আমি ও বেশ কেঁদেছিলাম

বলেছিলাম ভালবাসার মুল্য দেওয়া এত সহজ নয়।

যৌবন পেড়িয়ে বৃদ্ধের পথে হাটছি, শম্তান নিয়ে এত কষ্টো করছি, তবু ও বাপের বাড়ির কারও কাছে হাত পাতিনি, এবং বলেনি কষ্টে আছি।

আমার নাম সুরাইয়া, মধ্যবৃত্ত পরিবারে আমার জন্ম।

আমার জন্ম ষ্হান সাভার, মনাই এর বাবা গাড়ীর হেলপার ছিল। আমি তখন নবম শ্রেনীর ছাত্রী।

স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রায় দেখা হত, কথা হত

বাদাম জালমুড়ি কিনে দিতো তখনো বুজিনি আমি ভাল বেসে ফেলেছি ?

হঠাৎ একদিন আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে এলো এবং পছন্দ করলো। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল। তখন বুজতে পারলাম আমি কাউকে ভাল বেসে ফেলেছি,

কেঁদে আর কি হবে, বিয়ের আগে অন্ততো তাকে জানিয়ে যাই আমি তাকে ভালবাসি।

নিয়তী যেখানে জোড়া বেঁধে রেখেছে, সময় তা সহজ করে দেয়। 

স্কুলের বান্দবীদের দাওয়াত দেওয়ার উপলক্ষে বাসা থেকে বের হয়েছি টেম্পুষ্টানে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।

 এমনেতেই বর্ষাকাল, তারপর সে বার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। অগত্য কি করার লেগুনা গাড়িতে আশ্রায় নিলাম দেখি মোর্শেদ ভাই গাড়িতে বসা বিয়ার সব ঘটনা জানালাম।সব কিছু জানার পর মোর্শেদ ভাই বললো তুমি কি চাও সুরাইয়া ।

আমি কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম আমি তোমাকে ভাল বাসি, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। 

মনার বাবা বললো তুমি কি করতে চাও সুরাইয়া।

দশই আষাড় বিয়ের দিন ধার্য করা হল। আত্মীয় স্বজন দাওয়াত দেওয়া ছিল। অনেকে দুই দিন আগেই চলে এসেছে। বাড়ি ভরা মেহমান,এ কাজ ও কাজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। আমার বান্দবীদের দাওয়াত হয়েছে। জুলিয়া নামের আমার কাছের বান্দবী ছিল,

জুলিয়া মোর্শেদ এর সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে সবই জানতো।

বিয়ের দিন যতই ঘনিয়ে আসে মনের ব্যাকুলতা ততোই বাড়তে থাকে, কি জানি কি হয় এমন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

জুলিয়ার সাথে মোর্শেদ ভায়ের সব সময় যোগাযোগ

ছিল। আমি সব সময় সুযোগ খুজছিলাম কখন বেড়োবো।

বিয়ের আগের রাত, বাড়ির সবাই আনন্দ মেতেছিল

কেউ বা গান কেউ নাচ নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

আমি সেদিন অঝরে কেঁদে ছিলাম লোক চক্ষুর আড়ালে। জানি কোন দিন দেখা হবে না, এ মাটিতে

আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি। আমার সিন্ধান্ত মেনে নিবে না কেউ, তারপর ও যেতে হবে আমার। জুলিয়ার কাছে পাঠানো বোরকা ও চিঠি সন্ধ্যা রাতে

হাতে পেয়েছি। নবনীতা তখন আমার বাবার কথা বেশ মনে পড়ছিল, ইচ্ছে করছিল বাবাকে জড়িয়ে ধরে মনের মতো কাঁদি। সে আমি পারিনি আমার বিবেক আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজও।

মেঘ ভাসা চাঁদ, হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘগুলো দূরে যেন চোখের সীমানা ছেড়ে।

 

হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল আমি বোরকা পরে চুপে চুপে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে।

টেম্পু নিয়ে বাড়ির কাছেই অপেক্ষা করছিল মোরশেদ ভাই। দ্রুত গাড়ীতে বসতেই টেম্পু চলতে 

শুরু করলো আমার অজানার পথে। কিছুক্ষন পর হয়তো এ হাতে মেহদীর রঙে রঙিন হতো গায়ে উঠতো নতুন কোন শাড়ী। বাড়ির সবার আদরের ছিলাম।

বাড়ির সকলের ভালবাসা হারিয়ে একজন মানুষের

ভালবাসা পাওয়ার জন্য বাড়ির মা,বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন ছেড়ে এসেছি।

নবনীতা ভাল বাসা সহজ কিন্তু এর বিশ্বাস রাখা সহজ নয়।

কাকিমা তোমাকে তো কোন দিন তোমার বাবার বাড়ি যেতে দেখলাম না এমনকি তোমার বাবার বাড়ির কেউ আসছে বলে ও শূনেনি।

একটা রাতের আধাঁরে সেই যে হারিয়ে গেলাম চিরদিনের জন্য আর ফিরে পায়নি আমার পরিবারকে। 

অষ্ট-আশির বন্যা সে বছরই হয়েছিল, বন্যার সাথে হারিয়ে ফেলেছি জীবনের অনেক চেনা মুখ। মেহেদীর রং তখনো আমার হাত রাঙ্গা করা। জুলিয়ার মাধ্যামে পাঠানো কিছু আলংকার আর বাবার থেকে আনা, আমার বিয়ার খাট ও ফার্নিচার দেওয়ার জন্য ষাট হাজার টাকা দুই ভরি স্বর্ন এবং কিছু পোশাক নিয়ে আইছিলাম। এই সম্ভলই এ জীবনের কর্ম সংষ্হানের উপায় মাত্র।

 

কখন ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙ্গার পর মোরশেদ উরুর উপর মাথা রেখে ছিলাম। রাত ভর বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া নিয়ে টেম্পু ছুটে চলছে ফরিদ পুরের উদ্দেশ্য।

আজ দেড়দিন চলে মুখে কোন দানা পানি উঠেনি ।

শরীরে কোন শক্তি নেই, তখন আরিচা হয়ে লন্চ- ফেরি দৌলদদিয়া চলাচল করে।

ফেরিতে টেম্পু তুলে মনার বাবা খাবারের করতে ফেরির তিন তলায় উঠলো আমাকে নিয়ে। সাথে মনার বাবার বন্ধু বারেক ভাই, যার কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। 

-----------------------------------

            চলবে


Azizur Rahman

38 ব্লগ পোস্ট

মন্তব্য