? উপন্যাস: হারাতে নেই
✍️ লেখক: আজিজুর রহমান
অধ্যায় ১: স্বপ্নের শুরু
১৯৬০ সালের পুবালী হাওয়া গায়ে মেখে রোদ্দুর গাছপালার ফাঁক গলে গ্রামটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নড়াইল জেলার এক প্রান্তে ছোট্ট একটা গ্রাম—কাঠালতলা। গ্রামটি যত না বড়, তার চেয়েও বড় তার ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলের বহু স্মৃতি আজো জড়িয়ে আছে এই গ্রামের গলির ধুলায়।
পুকুরপাড়ে বসে ছিলো আরিফ। বয়স মোটে ষোল, কিন্তু চোখে মুখে তারুণ্যের জেদ। তার বাবা, হামিদ মোল্লা, গ্রামের একজন সৎ কৃষক। তিন পুরুষের ভিটেমাটি আর জমিজমা নিয়ে সংসার চলে, কিন্তু আরিফের মন জমিতে পড়ে না। তার চোখ শহরের দিকে। সাদা জামা-প্যান্ট পরা মানুষগুলোর মতো হতে চায় সে, যারা কলম দিয়ে ভবিষ্যৎ লিখে।
“তুই শহরে যাইবি? পোলাপানরে খাওয়াইয়া মানুষ করতে হইব আগে,” মা বললো ভাত বেড়ে দিতে দিতে। আরিফ চুপ করে বসে রইলো। মা জানে না, তার বুকের মধ্যে যে আগুনটা জ্বলতেছে—তা থামানো আর সহজ না।
সন্ধ্যাবেলা চায়ের দোকানে হাজির হলো বন্ধু রহিম। “শোনছিস? কাল নড়াইল স্কুলে বক্তৃতা দিবে এক ছাত্রনেতা। আওয়ামী লীগের পোলাপান নাকি!” আরিফের চোখ চমকে উঠলো। “চল, আমরাও যাই। একবার শহরের বাতাসটা গায়ে লাগাই,” সে বললো।
পরদিন সকালে মা'র চোখ ফাঁকি দিয়ে, বাবার ধুতি থেকে পাঁচ টাকা ধার নিয়ে রওনা হলো আরিফ আর রহিম। শহরে ঢোকার সময় ভ্যানে বসে তাদের বুক কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিলো অজানা রোমাঞ্চ।
স্কুল মাঠে তখন হাজারো মানুষের ভিড়। মাইকে ছাত্রনেতা বলছে— "পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রেরা এখন জেগেছে! আমাদের ভাষা, আমাদের অধিকার, সব কিছুর জন্য এখন লড়তে হবে।" তার প্রতিটা শব্দ যেন আরিফের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ উঠলো, "এই যে, তুমি ছাত্র?" ঘুরে তাকিয়ে দেখে—চশমা পরা এক যুবক, হাতে একটা বই। "হ্যাঁ," আরিফ বললো কাঁপা গলায়। "ভবিষ্যতের কথা ভাবো। একদিন এই মাঠেই হয়তো তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে," সে বলেই চলে গেল।
সেই রাতে গ্রামের পথে ফেরার সময় আরিফ জানতো—সে আর আগের আরিফ নেই। এখন তার বুকের ভেতর শুধু একটাই কথা বাজে— "জীবন শুধু কাটানোর জন্য না, কিছু করে যাওয়ার জন্য।"
চলবে?