পুড়ানো দিনের প্রেম

ভালোবাসা ভালোলাগা নতুন কিছু না।

গল্পের চাইতে বড় বড়ো গল্প আমাদের জীবনে প্রতিদিনই ঘটে যায়। কেউ বুঝতে পারে, কেউ পারেনা। কেউ ভুলতে পারে, কেউ পারেনা। কেউ অপেক্ষায় থাকে, আবার কেউ হয়তো অপেক্ষাই করতে জানেনা। 

 

সেরকম একটা গল্প আআপনাদের সাথে শেয়ার করছি আজ। ঘটনার স্পর্শকাতরতার জন্য পাত্র-পাত্রীর নাম উল্লেখ করা হলোনা। এতে করে গল্পের রস আস্বাদনে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটবে না। 

 

 

আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগের কথা। একটা মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলে একটা ছেলে, তা-ও প্রায় মাস ছয়েক হয়ে গেছে। কথা বলতে শুধুমাত্র দু'টি আওয়াজ, 'কেমন আছো,' বা এমন কিছু একটা। এতোদিন হয়ে গেলো, এদের কেউ কাউকে কখনো দেখেনি।

শুধুই ফোনে আলাপ করে সুন্দর একটা বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিলো এই দু'জনের মধ্যে। 

মেয়েটি ছিলো ছেলেটির এক বন্ধুর পাড়ার ছোট বোন। আর মেয়েটির কাছে ছেলেটি হলো, মেয়েটির পাড়াতো বড় ভাইয়ের বন্ধু। সে ভাবেই পরিচয়। ছেলেটির বন্ধুই মেয়েটিকে ছেলেটির নাম্বার দিয়েছিলো, নেহায়েত দুষ্টুমি করার জন্য। 

যে সময়টির কথা বলছি, সে সময়ে ইন্টারনেট ছিলো না, মোবাইল ফোন ছিলো না। আজকের মতো এতোটা সহজ অনেক কিছুই ছিলো না, ছেলে-মেয়েদের অনায়াস দেখা-সাক্ষাৎ, প্রেমনিবেদন তো নয়ই। তা-ই বলে সেসময়ে যে প্রেম-ভালোবাসা ছিলো না, তা' কিন্তু নয়! তখন প্রেম ভালোবাসার এক গুরুত্বপূর্ণ 'বাহন' ছিলো টেলিফোন। জি, লম্বা তারের, বাবা-মায়ের জিম্মায় থাকা টেলিফোন। ল্যান্ড লাইন বলে ডাকে এদের আজকের অনেকে। ল্যান্ডলাইনের সুযোগ অনেকেই নিতেন নিখাদ মজা করবার জন্য। 'রং নাম্বার' নামে একটা খেলা প্রচলিত ছিলো তখন। তো, দুষ্টুমি থেকেই আলাপ, বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, ভালোবাসা, শেষে পরিণয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না, তখন দখলে থাকা 'দুষ্টু' প্রকৃতির 'বালক-বালিকা'দের মাঝে। সে-ই দুষ্টুমি তখন একসময় প্রেম-পরিণয় পর্যায় পর্যন্তও গড়াতো যেহেতু, তাই হয়তো, এই অধ্যায়টিকে অনায়াসে বলা চলে, 'ল্যান্ড লাইনের দিনগুলোতে প্রেম।' চলুন, ফিরে যাই আমাদের গল্পে..

দিনটা ছিলো পঁচিশে আগস্ট ১৯৯২। রাত ১২:৪৫ থেকে ১টার মাঝে কোনো একটা সময়ে মেয়েটির সাথে প্রায় অন্য দিনের মতো কথা বলছিলো আমাদের সেই দুষ্টু ছেলেটি। এরমধ্যে, ছেলেটি কিছু দিন আগেই বাথরুমে পরে গিয়ে মুখে ভীষণ আঘাত পায়, তার উপরের মাড়ি ফ্র্যাকচারসহ সামনের দুই দাঁতের নীচের অংশ গুড়িয়ে যায়। যার কারনে ছেলেটি তখন বনানীর কাকলিতে অবস্থিত একটা ডেন্টাল ক্লিনিকে দাঁতের চিকিৎসা করায়। তো, তার চিকিৎসা করছিলো এক সুন্দরী ডাক্তার, নাম ধরা যাক, রুমানা! সেই নিয়ে ছেলেটি প্রায়ই মেয়েটিকে বলতো ঐ সুন্দরী ডাক্তারের কথা। ২৪ তারিখে ছেলেটির ডেন্টাল সেশনের কথা মেয়েটিকে বলছিলো, 'জানো আজ রুমানা এতো মিষ্টি একটা হ্যান্ড ক্রীম ব্যবহার করেছিলো যে, পুরা ভেনিলা আইস ক্রীমের গন্ধ!' ' যখন আমার মুখে হাত দিয়েছে দাঁতের কাজ করার জন্য, মন চাইছিলো হাতটা কামড়ে খেয়ে ফেলি,' আরও বলে সে। ব্যাস, যেইনা এই কথা বলেছে, মেয়েটি তো ক্ষেপে আগুন! বলে, 'আপনি কী মনে করেছেন আমাকে, এই কথাগুলি বললে আমি জেলাস হবো? হ্যাঁ, আমি অনেক, অনেক জেলাস!' বলেই ধাম করে ফোন রেখে দিলো! ছেলেটি তো প্রথম ধাক্কাতেই স্তব্ধ হয়ে গেছে, 'এটা কী হলো' ভেবে।  

হ্যাঁ, কথা বলতে বলতে একটা ভালো লাগা অবশ্যই তৈরী হয়েছিলো, কিন্তু এভাবে হঠাৎ রিয়েক্ট করবে মেয়েটি, তা' সে ভাবতেই পারেনি। এরপর, ছেলেটি যতই ফোন করে না কেনো, মেয়েটি আর ফোন ধরে না, একটুমাত্র উঠিয়েই কেটে দেয়।

 

একদিন ছেলেটিরও জেদ চেপে গেলো, কথা আজকে বলতেই হবে। সেই রাতে বাহাত্তর বার ওকে ফোন করছিলো, কিন্তু বান্দা ফোন ধরেনি। অবশেষে তিহাত্তরবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে রাত ২টা বেজে ৮ মিনিটে। ফোন ধরা মাত্রই ছেলেটি বলে সেই অমোঘ বাণী, 'পাগলী, আমি তোমাকে ভালোবাসি!' মেয়েটি একটু চুপ থেকে বলে, 'আমিও ভালোবাসি!' 

 

ব্যাস, হয়ে গেলো! দুটি ধারকের বাহন মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ায় যা ঘটে গেলো এখন, তার নাম, 'প্রেম।' এই হলো আমাদের আজকের আজব প্রেমের গজব কাহিনী। দুটি মানুষ কেউ কাউকে দেখেনি কোনোদিন, শুধু দুটি কন্ঠ অন্ধভাবে দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে ফেলে!

বলে রাখা ভালো, এদের প্রথম দেখা হয়েছিলো তাদের 'প্রেম নামক বিকৃয়া ঘটার' দু'দিন পর, অর্থাৎ, ২৭ তারিখ, ছেলেটির জন্মদিনের দিন। 

 

তাদের দু'জনের একটুও দ্বিধা ছিলো না যে, তারা কে কেমন দেখতে, বা কী। তারা শুধু জানতো, ছেলেটির ভাষায়, 'No matter what.. ভালোবাসি। ব্যাস, ভালোবাসি!' মেয়েটির কথা জানবার সুযোগ হয়নি...

 

সামনের মাসের ১৬ তারিখে মেয়েটির ১০ম মৃত্যু বার্ষিকী।

 

•সংযোজন: 

 

একটা মাত্র সন্তান ওদের। বড়ো হয়ে গেছে ওদের ভালোবাসার একমাত্র নিদর্শন। ছেলেটার নিজের সংসার হয়নি যদিও এখনো, বাপ-বেটা একজন অপরজনের ভালোবাসা হয়ে বেড়ে উঠছে।

 

আমার বন্ধু একলাই আছে। মেয়াটার নাম ছিলো...। থাক, নাম বলবোনা বলে আগেই বলেছিলাম! আমার বন্ধুটি স্মৃতি তর্পন করে ওর ভালোবাসার। প্রতিটি দিন, ক্ষণ, ঘটনা ওর স্মৃতির পাতায় গাঁথা। আর আমি হাজার মাইল দূরে থেকে চোখের পানি ফেলি ওর স্মৃতিময় ভালোবাসার জোর দেখে। 

 

কীভাবে কী হলো, জিজ্ঞেস করবার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারিনি। কখনো পারবো কীনা, তাও জানিনা। আর সেই অক্ষমতা থেকেই আমার এই প্রচেষ্টা।

 


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments

📲 Download our app for a better experience!