দেনা-পাওনা সতেরো

ষোড়শীর যখন চেতনা ফিরিয়া আসিল, তখন সাগর চলিয়া গেছে।

মন্দিরের ভৃত্য ডাকিয়া কহিল, মা, এবার দোর বন্ধ করি?

 

কর, বলিয়া সে চাবির জন্য দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেবেলা হইতে জীবনটা তাহার

 যথেষ্ট সুখেরও নয়, নিছক আরামেও দিন কাটে নাই; বিশেষ করিয়া যে অশুভ মুহূর্তে

 বীজগ্রামের নূতন জমিদার চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তখন হইতে

 উপদ্রবের ঘুর্ণিহাওয়া তাহাকে অনুক্ষণ ঘেরিয়া নিরন্তর অশান্ত, চঞ্চল ও

 বিশ্রামহীন করিয়া রাখিয়াছে। তবুও সে-সকল সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের ন্যায়,

 আজ যেখানে সাগর সর্দার তাহাকে এইমাত্র নিক্ষেপ করিয়া অন্তর্হিত হইল।

 অথচ যথার্থই সে যে এতবড় ভয়ঙ্কর কিছু একটা এই রাত্রির মধ্যে করিয়া উঠিত

 পারিবে, তাহা এমনি অসম্ভব যে ষোড়শী বিশ্বাস করিল না। অথবা এ আশঙ্কাও

 তাহার মনের মধ্যে সত্য সত্যই স্থান পাইল না যে, যে লোক হত্যা, রক্তপাত ও হিংসার

 সর্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও আয়োজনে পরিবৃত হইয়া অহর্নিশি বাস করে, পাপ

 তাহার যত বড়ই হোক, কেবলমাত্র সাগরের লাঠির জোরেই তাহার

 পরিসমাপ্তি ঘটিবে। তথাপি দৈব বলিয়া যে শক্তির কাছে সকল অঘটনই হার

 মানে, তাহারই ভয়ে বুকের মধ্যে তাহার মুগুরের ঘা পড়িতে লাগিল।

 

মন্দিরের দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া ভৃত্য চাবির গোছা হাতে আনিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা

 করিল, রাত অনেক হয়েচে মা, সঙ্গে যেতে হবে কি?

 

ষোড়শী মুখ তুলিয়া অন্যমনস্কের মত বলিল, কোথায় বলাই?

 

তোমাকে পৌঁছে দিতে মা।

 

পৌঁছে দিতে? না, বলিয়া ষোড়শী ধীরে ধীরে স্বপ্নাবিষ্টের মত বাহির হইয়া গেল।

 

প্রত্যহের মত এই পথটুকুর মধ্যেও অতি সর্তকতা আজ তাহার মনেই হইল না।

 রাত্রির প্রগাঢ় অন্ধকার, কিন্তু এ-কয়দিনের ন্যায় ঝাপসা মেঘের আচ্ছাদন আজ ছিল না।

স্বচ্ছ নির্মল কৃষ্ণা-দ্বাদশীর কালো আকাশ এইমাত্র যেন কোন্‌ অদৃশ্য পারাবারে স্নান করিয়া আসিয়াছে, তাহার আর্দ্র গা-মাথায় এখনও যেন জল মাখানো রহিয়াছে।

 মন্দির হইতে ষোড়শীর কুটীরখানির ব্যবধান যৎসামান্য; এই আঁকাবাঁকা পায়ে-হাঁটা ধূসর পদরেখাটির উপরে একটি

 স্নিগ্ধ আলোক অসংখ্য নক্ষত্রলোক হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে; তাহারই উপর দিয়া সে নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাহার ঘরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল।

তাহার অবিশ্বাসের কণ্ঠস্বর অকারণে অত্যন্ত কঠোর হইয়া বাজিল, তথাপি বুড়া হরিহর কি-একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ভাইপো সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে বাধা দিল। কহিল,

 কি হবে মা, তোমার সে কথা শুনে? তোমরা ভদ্রলোকেরা যখন আমাদের ছোটলোকের কথা বিশ্বাস করতে পারবে না!

ভদ্রলোকেরা যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে, সেও সত্যি পাওনার দাবিতে, আবার যখন জেলে দিলে, সেও তেমনি সত্যি সাক্ষীর জোরে।

 জজসাহেবের আদালত থেকে মা চণ্ডীর মন্দির পর্যন্ত ছোটলোকের কথা বিশ্বাস করবার ত কেউ নেই মা! চল, ছোটখুড়ো, আমরা ঘরে যাই।

 বলিয়া সে চট করিয়া হেঁট হইয়া ভৈরবীর পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া প্রস্থান করিল। হরিহর নিজেও প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিয়া সলজ্জ-কণ্ঠে কহিল, রাগ করো না মা

, ও ব্যাটা ঐ রকম গোঁয়ার, ও কথা কারু সইতে পারে না। বলিয়া সেও ভ্রাতুষ্পুত্রের অনুগমন করিল।

 

হোক ইহারা অন্ত্যজ, হোক ইহারা দস্যু; যতক্ষণ দেখা গেল ষোড়শী স্তব্ধবিস্ময়ে এই হীনবীর্য, অবমানিত,

 অধঃপতিত বাঙলাদেশের এই দুটি সুস্থ, নির্ভীক ও পরম শক্তিমান পুরুষদিগের প্রতি চাহিয়া রহিল।

 

পরদিন প্রভাতেই ষোড়শী সাগরকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিল, তোদের কাছে বাবা, কাল আমি অন্যায় করেছি।

বিঘে দশ-পনর জমি আমার এখনো আছে, তোরা খুড়ো-ভাইপোতে তাই ভাগ করে নে।

 মায়ের খাজনা তোরা যা খুশি দিস্‌, কিন্তু অসৎপথে আর কখনো পা দিবিনে এই আমার শর্ত।

সেই অবধি সাগর আর হরিহর তাহার ক্রীতদাস। তাহার সকল কর্মে সকল সম্পদে তাহারা ছায়ার মত অনুসরণ করিয়াছে, সকল বিপদে বুক দিয়া রক্ষা করিয়াছে।

 এই যে ভাঙ্গা কুটীর, এই সঙ্গীবিহীন বিপদাপন্ন জীবন, তবু যে কেহ তাহার কেশাগ্র স্পর্শ করিবার দুঃসাহস করে না, সে যে কিসের ভয়ে এ কথা ত তাহার অবিদিত নাই।

তথাপি সেই সাগরের যে মূর্তি আজ সে চোখে দেখিয়া আসিল তাহাতে ভরসা করিবার, বিশ্বাস করিবার আর তাহার কিছুই রহিল না।

 সে ডাকাতি করে কিনা বলা কঠিন; কিন্তু প্রয়োজন বোধ করিলে ইহার অসাধ্য কিছু নাই— তাহার সমস্ত আয়োজন ও উপকরণ আজও তেমনি সজীব আছে, এবং মুহূর্তের আহ্বানে তাহারা আজও তেমনি সাজিয়া দাঁড়াইতে পারে, এ সংশয় আর ত ঠেকাইয়া রাখা যায় না।

 

ছেঁড়া একখানা কাগজের টুকরা একপাশে পড়িয়া ছিল, অন্যমনস্কভাবে হাতে তুলিয়া লইতেই তাহার প্রদীপের আলোকে চোখে পড়িল, হৈমর চিঠির জবাবে সেদিন যে চিঠিখানা সে লিখিয়াও ভাল হইল না

 ভাবিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আর একখানা লিখিয়া পাঠাইয়াছিল ইহা তাহারই অংশ। অনেক রাত্রি জাগিয়া দীর্ঘ পত্র যখন শেষ হয়,

তখন একবার যেন সন্দেহ হইয়াছিল এত কথা না লিখিলেই হইত—পরের কাছে আপনাকে এমন করিয়া ব্যক্ত করা হয়ত কিছুতেই ঠিক হইল না,

কিন্তু নিদ্রাহীন সেই গভীর রাত্রে ঠিক করিবার ধৈর্যও আর তাহার ছিল না। কিন্তু পরদিন ডাকে ফেলিয়া দিতে যখন পাঠাইল, তখন না পড়িয়াই পাঠাইয়া দিল।

 তাহার ভয় হইল পাছে ইহাও সে ছিঁড়িয়া ফেলে—পাছে আজও তাহার হৈমকে উত্তর দেওয়া ঘটিয়া না ওঠে। এ কয়দিন

 যাহা ভুলিয়াছিল, আজ একে একে সেই চিঠির কথাগুলাই মনে পড়িয়া তাহার ভারী লজ্জা করিতে লাগিল—ভয় হইতে লাগিল পাছে তাহার নির্যাতনের

 কাহিনীটুকু কেহ ভুল বুঝিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে আসিয়া উপস্থিত হয়। এই হৈম ও তাহার স্বামীকে মনে পড়িলেই মন যেন তাহার কেমন বিবশ হইয়া আসিত।

 ইহাদের শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রার ধারার সহিত তাহার বিশেষ পরিচয় নাই, তবুও কেমন করিয়া যে স্বপ্ন রচিয়া উঠিত,

 কেমন করিয়া যে কাজের চিন্তা তাহার এলোমেলো কল্পনায় পর্যবসিত হইত, কখনো হৈম, কখনো নির্মলের সূত্র ধরিয়া কি করিয়া যে ইহাই একসময়ে সমস্ত সংযমের বেড়া ভাঙ্গিয়া অকস্মাৎ লজ্জায় ফাটিয়া পড়িত,

তাহা সে নিজেই ভাবিয়া পাইত না। অথচ নিজের মনের এই মোহাবিষ্ট লক্ষ্যহীন গতিকে সে চিনিত, ভয় করিত, লজ্জা করিত, এবং সকল শক্তি দিয়া বর্জন করিতে চাহিত।

সেই উতলা আবেগের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে পত্রখণ্ড খান খান করিয়া ফেলিয়া দিয়া শক্ত হইয়া বসিল। মনে মনে দৃঢ়বলে কহিল, কিসের জন্য হৈমদের এত কথা আমি বলিতে গেলাম! কোন্‌ সাহায্য তাহাদের কাছে আমি ভিক্ষা করিয়া লইব?

 কিসের জন্য লইব? দেবীর ভৈরবীপদের মধ্যে কি আছে যে এমন করিয়া আঁকড়াইয়া থাকিব?

যে-কেহ নিক না, কি আমার আসিয়া যায়?

ইহারা সবাই ত চোর-ডাকাত। যাহার যত শক্তি সে তত বড়ই দস্যু। সুবিধা ও সামর্থ্য মত অপরের গলা টিপিয়া কাড়িয়া লওয়াই ইহাদের কাজ।

এই ত সংসার, এই ত সমাজ, এই ত মানুষের ব্যবসা! পীড়িত ও পীড়কের মাঝখানে ব্যবধান কতটুকু যে অহর্নিশি এমন ভয়ে ভয়ে আছি!

কিসের জন্য আমার এতবড় মাথাব্যথা! কিসের জন্য এতবড় বিরোধ সৃষ্টি করিয়াছি! এই ভৈরবীর আসন ত্যাগ করা কিসের জন্য এতবড় কঠিন!

মুহূর্তের জন্য মনে হইল এ কাজ তাহার পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়, কাল সকালেই সে এককড়ি ও জনার্দন রায়কে লিখিয়া পাঠাইয়া ভৈরবীর সকল দায়িত্ব স্বচ্ছন্দে ফিরাইয়া দিতে পারে, কোথাও কোন টান, কোন ব্যথা তাহার বাজিবে না।মারতে এসেচেন। কিন্তু আপনার কি করেচি আমি?

 

জীবানন্দ কহিল, লোক নিয়ে মারতে এসেচি! তোমাকে? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে দেখতে এসেচি।

 

ষোড়শ আর কথা কহিল না। তাহার চোখে জল আসিতেছিল, এই কদর্য উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল।

 এবং সেই শুষ্ক চক্ষু ভূমিতলে নিবদ্ধ করিয়া সে নিঃশব্দে বসিয়া রহিল; এবং অদূরে বসিয়া আর একজন তাহারই আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত দৃষ্টি স্থির করিয়া তাহারি মত চুপ করিয়া রহিল।


Akhi Akter Mim

313 Blogg inlägg

Kommentarer

📲 Download our app for a better experience!