কোরআন সুন্নাহ ও বিজ্ঞানের আলোকে পড়া আগে নাকি লেখা আগে? আসুন আমরা এই বিষয়টিকে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করি।
কোরআনের আলোকে
কোরআনের প্রথম যে আয়াতটি নাজিল হয়েছে, সেটি হলো সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। এর মধ্যে প্রথম শব্দটিই হলো 'ইকরা' (اِقْرَأْ), যার অর্থ 'পড়ো'। এই আয়াতটি হলো:
> 'পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।' (সূরা আলাক, আয়াত ১)
>
এখানে আল্লাহ প্রথমে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
> 'যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।' (সূরা আলাক, আয়াত ৪)
সুতরাং
এই( اقرا ) তথা পড় শব্দটি কোরআনে ৩ বার এসেছে। সূরা আলাকের প্রথম দুটি আয়াতে এবং আরেকটি আয়াতে।
* সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ১:
* اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ
* সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৩:
* اِقْرَاْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ
* সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ১৪:
* اِقْرَاْ كِتٰبَكَ
এবং اعلم তথা জেনে রেখো বা জ্ঞান অর্জন কর এই শব্দটি কোরআনে প্রায় ৫৪ বার এসেছে।
এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
১-* সূরা মুহাম্মাদ (৪৭), আয়াত ১৯:
* فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ
২-* সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ৭:
* وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ
সূরা আল-বাকারাহ (২)
৩-* ২৩৩: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
৪-* ২৪৪: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
৫-* ২৬৭: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
সূরা আলে ইমরান (৩)
৬- * ১৬৬: وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ
সূরা আল-মায়িদাহ (৫)
* ৭: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
* ৯৮: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
সূরা আল-আনফাল (৮)
* ৪১: وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
সূরা আত-তাওবাহ (৯)
* ৩৬: إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْراً فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمتقين*
সূরা আল-হুজুরাত (৪৯)
* ৭: وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِنَ الأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُولَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ*:
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ প্রথমে পড়া বা জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন এবং এরপর কলম ও লেখার কথা বলেছেন।
এর মানে হলো, কোরআনের দৃষ্টিতে পড়া (জ্ঞান অর্জন) হলো প্রথম এবং প্রধান বিষয়।
তারপর সেই জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য লেখার কথা এসেছে।
সুন্নাহর আলোকে
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনেও আমরা এর প্রমাণ পাই। (তিনি নিজেই কোন মানুষ থেকে আক্ষরিক জ্ঞান শিখেনি যদি শিখত তাহলে লোকেরা বলত যে তিনি অমুক শিক্ষক থেকে শিখে আমাদের কাছে প্রচার প্রসার করে যাচ্ছে সুতরাং এই টা আল্লাহর কালাম নয়,এই অভিযোগ খন্ডন হওয়ার জন্য তার উপাধি ছিল উম্মি যার অর্থ -অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তি )
এতদাসত্তেও
তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিতেন। বদর যুদ্ধের বন্দিদের বিনিময়ে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে, তারা যদি মুসলিম শিশুদের লিখতে শেখায়, তাহলে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। এটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, তিনি জ্ঞান অর্জন এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লেখাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে বলেছেন।
সুতরাং, সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যদিও পড়া প্রথমে আসে, কিন্তু লেখাকে একটি অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে জ্ঞানকে স্থায়ীকরণ ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানের আলোকে
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।
১. মৌখিক জ্ঞান আগে আসে: মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমে মৌখিক জ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছে। মানুষ কানে শুনে বা মুখে বলে জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পৌঁছে দিতো। এটি পড়ার একটি আদিম রূপ। লেখার আবিষ্কার এর অনেক পরে হয়েছে।
২. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা:
মানুষের মস্তিষ্ক প্রথমে শোনার এবং বোঝার ক্ষমতা অর্জন করে। একটি শিশু প্রথমে কথা বলতে ও শুনতে শেখে, এরপর সে অক্ষর জ্ঞান ও লেখার দক্ষতা অর্জন করে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
৩. জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান সংরক্ষণ:
জ্ঞানার্জন বা পড়া হলো মস্তিষ্কে তথ্য গ্রহণ করার প্রক্রিয়া। আর লেখা হলো সেই তথ্যকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার একটি মাধ্যম। জ্ঞানার্জন (পড়া) প্রথমে না হলে জ্ঞান সংরক্ষণ (লেখা) সম্ভব নয়।
উপসংহার
কোরআন, সুন্নাহ এবং বিজ্ঞানের সম্মিলিত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, 'পড়া' (জ্ঞান অর্জন) হলো প্রথম এবং প্রধান বিষয়। 'লেখা' হলো সেই জ্ঞানকে সংরক্ষণ, স্থায়ীকরণ এবং অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তাই কোরআন প্রথমে পড়ার কথা বলেছে। আমরা হয়তো দৈনন্দিন জীবনে 'লেখা-পড়া' বলে থাকি, কিন্তু এর মূল ভিত্তি হলো পড়া। জ্ঞানার্জনই হলো মূল উদ্দেশ্য, এবং লেখার মাধ্যমে আমরা সেই উদ্দেশ্যকে আরও সফল করি।