গল্পের নাম: আলো আর অন্ধকার
একটা ছোট্ট গ্রাম—চাঁনপুর। নামের মতোই মায়াবী, নদীর ধারে সবুজে ঘেরা। গ্রামে এক বৃদ্ধ থাকতেন, নাম ছিল রব্বান আলী। বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি, কিন্তু এখনো ভোরে উঠে নদীর ঘাটে যান, নামাজ পড়ে, কাঁধে লাঠি নিয়ে হাঁটেন মাঠের পথ ধরে। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।
রব্বান আলীর একটা ছেলে ছিল—সালেহ। শহরে চাকরি করত। মাসে মাসে টাকা পাঠাত, মাঝে মাঝে ফোন করত। তবে গ্রামের প্রতি তার কোনো টান ছিল না, বাবাকেও শহরে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু রব্বান আলী রাজি হননি।
একদিন হঠাৎ খবর এল—সালেহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। গোটা গ্রাম স্তব্ধ। রব্বান আলী কাঁদলেন না। চুপচাপ জানাজা করলেন, কবরস্থ করলেন, তারপর সেই রাতেই ঘরের এক কোণে বসে ছোট একটা লণ্ঠনের আলোয় ছেলে আর ছেলের ফেলে যাওয়া শহুরে জীবনের স্মৃতিগুলো গুনে গুনে দেখতে লাগলেন।
এরপর থেকেই তাঁর ঘরে নিয়ম করে একদল শিশু জড়ো হতে লাগল। রব্বান আলী তাদের গল্প বলেন—মহানবীর গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, নদীর গল্প, আকাশের গল্প। মাঝে মাঝে অঙ্ক শেখান, ইংরেজি শেখান। গ্রামের লোকেরা অবাক হয়ে দেখতে লাগল—বৃদ্ধ যেন আবার তরুণ হয়ে উঠেছেন।
একদিন কেউ জিজ্ঞেস করল, "চাচা, এত কিছু করেন কেন? আপনার তো বিশ্রামের সময়।"
তিনি হেসে বললেন, “সালেহ যেটা পারেনি, আমি সেটা করছি। আলো ছড়াচ্ছি।”
আলো... সত্যিই যেন আলো ছড়াতে শুরু করল ঘরটায়। চারপাশের শিশুরা শিক্ষিত হতে লাগল, তারা বই পড়তে শিখল, প্রশ্ন করতে শিখল। পাশের গ্রাম থেকেও বাচ্চারা আসতে লাগল। এক সময় স্থানীয় সরকার একটা ছোট পাঠাগার বানিয়ে দিল—রব্বান লাইব্রেরি।
গ্রামের মানুষের জীবনে রব্বান আলী হয়ে উঠলেন এক জীবন্ত বাতিঘর। তাঁর নিজের জীবন যেমন ছেলেহারা অন্ধকারে একসময় তলিয়ে যাচ্ছিল, তেমনি সেই অন্ধকার থেকেই তিনি আলো জ্বালালেন অন্যদের জন্য।
এক সন্ধ্যায়, সেই একই লণ্ঠনের আলোয়, রব্বান আলী চুপচাপ চলে গেলেন। তাঁর জানাজায় শুধু গ্রাম নয়, আশেপাশের অনেক এলাকা থেকে মানুষ এলো। অনেক শিশু, এখন যারা বড় হয়ে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তিনি আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন।”
রব্বান আলীর ঘরে আর কেউ নেই, কিন্তু জানালার পাশে এখনও সেই লণ্ঠনটা টিমটিম করে জ্বলছে। হয়তো সেটা এখন আর কেরোসিনে নয়, মানুষের স্মৃতিতে আলো জ্বালে।