#সতেরো হবে! চোখে-মুখে কী এক টান মেয়েটার! তার তাকানো, তার হাসি কেমন যেন ঘোর লাগানো। সে সামনের মানুষটাকে পুরোদমে হাসি আর তাকানো, কথার ভঙ্গি দিয়ে যেন মাত দিতে চাচ্ছে। কিন্তু বাহার ভাই ঠিক তেমন ভাবে তাকাচ্ছে না। তার জন্য এত তোরজোর করে হাসি দেওয়ার ব্যাপারটাকে যেন সে গায়েই লাগাচ্ছে না। কী যেন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে আবার ভেতরেও চলে গেলো।
মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইলো উদাস চোখে, আশাহত হয়ে। একটা গাঢ় সবুজ রঙের জামা পরনে মেয়েটির। চোখ ভর্তি কাজল, কপালে সবুজ টিপ আর বিরাট কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো দেখে খুব অনায়াসেই আঁচ করা যায় যে মেয়েটি এরকম সাজগোজ করেছিলো এই পুরুষ মানুষটার একটু দৃষ্টি পাওয়ার জন্য। একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্য কিন্তু সেটা মেয়েটি পায়নি। চিত্রার তো রাগ হওয়ার কথা, তার বাহার ভাইয়ের দিকে কেউ এরকম মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়েছে সেটা ভেবে ঈর্ষায় জ্বলে যাওয়ার কথা অথচ তেমন কিছুই হলো না। বরং করুণা জন্মালো বেশ। মায়া হলো মেয়েটার কথা ভেবে। মেয়েটার ভেতরে কোথাও একটা সে যেন নিজেকে দেখতে পেলো। বহু গুলো বছর, মাস কিংবা দিন আগে সে-ও তো এরকম করতো। বাহার ভাই যেন একটু তার দিকে তাকান, একটউ মুগ্ধ হোন সেই ভেবে কত আয়োজন ছিলো তার! কী না করেছে একটু মুগ্ধ দৃষ্টির জন্য। আজ যেন মেয়েটার এই ভগ্ন মোহের আদলটা সেই পুরোনো চিত্রাকে মনে করিয়ে দিলো।
চিত্রা নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। হেঁটে চলে গেলো ঐ পাশটায়। বাহার ভাইদের বাসার সামনে। ঠিক মেয়েটার এক হাত পাশে গিয়েই দাঁড়ালো। খুব নরম, কোমল স্বরে শুধালো,
"তুমি কে?"
মেয়েটি অন্য এক ঘোরে ছিলো। কোনো এক ভাবনায় খুব গভীর ভাবে ডুবে ছিলো। তাই চিত্রার আচমকা প্রশ্নে কিছুটা কেঁপে উঠলো। ঘোর লাগানো স্বরে বলল, "হু, হু?"
চিত্রা এবার মেয়েটার বাহুতে হাত দিলো। আশ্বস্ত করল ছোঁয়ায়,
"নাম কী তোমার? বাহার ভাইদের আত্মীয় হও তুমি?"
মেয়েটা ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ সে বাহার ভাইদের আত্মীয় নয়। অতঃপর বলল,
"আমি তমসা। তমু ডাকে সবাই। আর আপনার বাহার ভাই আমার টিচার হন। এই কিছুদিন আগেই পড়ানো শুরু করেছেন।"
গরম এক অদৃশ্য বাতাস যেন ছুঁয়ে গেলো চিত্রার শরীর। তমসার ভেতরে যে সে পুরোনো চিত্রাকেই দেখেছিল সেটা এক ফোঁটাও ভুল দেখা ছিলো না।
চিত্রা কৌতূহল থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, "কীসের জন্য এসেছিলে? কোনো কাজ ছিলো?"
তমসার ভেতরে আড়ষ্টতা। মিথ্যে বলবে না-কি সত্যি বলবে তা ভেবে ভেবে হয়তো হয়রান। চিত্রা সেই হয়রান হওয়া মুখ চোখকে চিনতে পারলো। কিন্তু কিছু বললো না। তার মনে হলো মেয়েটা তাকে সত্যিই বলবে। তাই আগে একটু ভেবেচিন্তে নিচ্ছে। এবং চিত্রার মনের কথা মিলেও গেলো। তমসা কতক্ষণ ভাবুক থেকে অতঃপর মিনমিন করে বলল,
"কাজ না অকাজ ঠিক বুঝতে পারছি না, আপু।"
"আমায় বলো কী করতে এসেছিলে, এরপর আমি বুঝে নিবো কাজ ছিলো না অকাজ।"
তমসা এবার চিত্রার কাছাকাছি এলো। ছাতার নিচে এঁটে গেলো দু'জনের শরীর। তমসা ফিসফিসিয়ে বলল,
"আগে বলুন আপনি কাউকে বলবেন না কিছু। স্যারকেও না।"
চিত্রা ভরসা দিয়ে বলল, "বলবো না।"
এবার তমসা মেয়েটা তুমুল উৎসাহ নিয়ে বলল,
"আসলে আমার আজ জন্মদিন ছিলো। স্যারকে আমি অনেক দিন যাবত বলে রেখেছিলাম জুলাইয়ের দুই তারিখ আমার জন্মদিন। কিন্তু স্যার একটু কল করে উইশও করেননি। আজ যেহেতু শুক্রবার স্যার পড়াতে যাবেন না তাই ভাবলাম আমিই আসি। আমাকে সামনে দেখলে উইশ না করে তো থাকতে পারবেন না। তাই বই কেনার উছিলায় স্যারের কাছে এসেছিলাম। স্যারকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম ম্যাথম্যাটিকসের সলিউশনের জন্য কোন বইটা কিনবো। কিন্তু আমার মূলত উদ্দেশ্য তো ছিলো অন্য। কিন্তু স্যার বুঝলে তো! উনি বুঝলেনই না! উইশ করবেন তো দূরের কথা।"
চিত্রা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। মেয়েটা কত্ত বোকা হলে এরকম অবলীলায় মনের সবটুকু কথা বলে দিলো! নিশ্চয় মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। তাই চিত্রার সাথে সেটা ভাগ করে নিয়েছে। মানুষ যে এমনই। কষ্ট পেলে কিংবা দুঃখ পেলে তারা আশ্রয় খোঁজে, একটা কোল খোঁজে যেন দুঃখের ভারটা কমানো যায়। যেমন করে উত্তপ্ত রোদে পুড়ে পথিক একটি বিশাল বটগাছের সন্ধান করে। এই মুহূর্তে তমসার বটগাছটা যেন চিত্রাই হয়ে উঠলো। তার বাহার ভাইকে দেখানোর জন্য মেয়েটা এত আশা নিয়ে ছিলো এটা ভেবে একটু রাগও হলো না তার। বরং মেয়েটার প্রতি মায়া থেকেই পুরো ব্যাপারটাকে হালকা করতে বলল,
"শুভ জন্মদিন, তমসা। হ্যাপি বার্থডে সুইটি। সবুজ জামাটাতে তোমায় পুরো রাজকন্যা লাগছ