আমার একটা রাত

একপ্রকার দমকা বাতাসের মতোই আমার নাক দিয়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো কেউ যেন আমার শ্বাসনালীটাকে সকল শক্তি

প্রানপনে কয়েকবার চোখের পাতা ফেলতেই আমার দৃষ্টি সামান্য পরিষ্কার হলো। দেখলাম আমার চোখের থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না। পরে একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলাম সেটা একটা ল্যাম্প পোস্টের আলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়! বহুদূর থেকে লড়ি বা বাস জাতীয় কিছু একটা চলে যাওয়ার আওয়াজ বেশ কয়েকবার কানে ভেসে এলো। চারিদিকে প্রচন্ড বাতাস বইছে। জলের কলতানও শুনতে পেলাম। কোথা থেকে একটা লঞ্চের ভেঁপুও বেজে উঠল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমি কোথায় আছি! মনে করার চেষ্টাও করলাম কিন্তু উফ্ মাথায় মধ্যে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার সমস্ত শিরাগুলো বোধহয় এক্ষুনি সব ছিঁড়ে যাবে। আমি ওঠার চেষ্টাও করলাম কিন্তু পারলাম না। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। যন্ত্রনা যেন আমার শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে অসাড় করে দিয়েছে। তারা কেউই যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমি অসহায়ের মতো পড়ে আছি। এইভাবে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর আমি স্থির করলাম, না আর পড়ে থাকলে চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে উঠতে হবে। শরীরের সমগ্র বল প্রয়োগ করে বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা করলাম। যন্ত্রনায় আমার কান্না পেয়ে গেলো। তবুও আমি হার মানলাম না। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। দেখলাম আমি একটা পীচের রাস্তার উপর শুয়েছিলাম এতক্ষণ। আমার ভীষণ অবাক লাগলো। আমি এখানে এলাম কি করে! আমার কোন কিছুই মনে পরছে না। আমি আমার ডানদিকের ল্যাম্প পোস্টটার গা ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। মাথার যন্ত্রণায় আমি ঠিক মতো দাড়াতে পারছিনা। মাথাটা এতো ভার লাগছে যেন মনে হচ্ছে এক্ষুনি আবার পড়ে যাবো। কিন্তু হার মানলে চলবে না। যেভাবেই হোক আমাকে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভাল করে দেখলাম। বুঝতে পারছিলাম না কোন দিকটাতে যাবো। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। মানুষ তো দূরস্ত একটা নেড়ি কুকুরও চোখে পড়ছে না। আমার বাঁ দিকে একটা রেল লাইন চোখে পড়লো আর তার ধারেই একটা বিরাট বড় গুদাম। রেল লাইনের এ ধারে কয়েকটা বড় বড় লড়ি ও ৪০৭ গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে। আমার ডান দিকে আগাছার জঙ্গল। তার গা ঘেঁষেই শান্ত ভাবে গঙ্গা নদী বইছে। পারে দুটো নৌকা বাঁধা আছে দেখলাম। আমি ঠিক করলাম সামনের দিকে এগোবো। তখন কত রাত হয়েছে জানিনা। হাত ঘরিটার দিকে তাকাতে দেখলাম সেটা ১০টা বেজে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ঘরির কাঁচটাও ভেঙ্গে চৌচির। আর কিছু না ভেবে আমার সমস্ত যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। কিছুটা এগোতেই বেশ সেকেলে গোছের একটা মন্দির চোখে পড়লো। মন্দিরটার কাছে আসতেই দেখলাম সেটার ফটক বন্ধ। তবে তার সামনে একটা বেশ লম্বা সরু আকারের গাছ দেখতে পেলাম। গাছটার নীচেরদিকে বেশ কিছুটা বাঁধিয়ে একটা বেদীর মতন বানানো। তারই উপরে একটি কালো রঙের পাথর রাখা। পাথরটার চারিদিকে ধূপকাঠির অবশিষ্টাংশ ও ফুল ছড়ানো দেখে বুঝলাম সেটাকে নিত্যদিন পূজা করা হয়। মন্দিরটাকে রেখে আরও কিছুটা পথ এগোতেই একটা ঘাট দেখতে পেলাম। সেখানের একটা পোষ্টের আলোতে দেখলাম ঘাটটা বেশ পুরনো। জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট খসে ভেতরের ইটগুলো দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুটা এগোতেই ওই ঘাটেরই সিঁড়িতে কতকগুলো মূর্তিকে বসে থাকতে দেখলাম। তাদের দেখে আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ভাবলাম হয়তো এরা স্থানীয় বাসিন্দা! যদি তাদের থেকে কোনরকম সাহায্য পাওয়া যায়, এই আশা নিয়েই আমি দ্রুতপদে ঘাটটির দিকে এগোতে লাগলাম। "এই যে শুনছেন" বলে ঘাটটির সামনে যেতেই আমার কথা আর পা - দুটোই থমকে গেলো। আমি হতবাকের মতো শূন্য ঘাটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোথায় সেই মূর্তিগুলো! সেখানে কেউই ছিলনা। যেন তারা আমাকে দেখতে পেয়েই শূন্যে লুকিয়ে পড়েছে। আমি বিস্ময়ে ও আতঙ্কে ধীরে ধীরে এক একটা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামতেই আমি হতাশ হয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। এই ঘটনার পর আমার ক্লান্তি যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম। "কিরে, অনিন্দ্য না!" হঠাৎ একটা প্রশ্ন শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম অন্বেষা, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। তবে ওইরকম অবস্থায় অন্বেষাকে পেয়ে আমি সত্যি বুকে প্রান ফিরে পেলাম। অন্বেষা হলো আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী। আমরা একই কলেজে পড়তাম। একসাথে ঘোরা ফেরা, কলেজ যাওয়া, পড়তে যাওয়া আরও কত কি! ওর সাথে বন্ধুত্বটা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, একদিন সমস্ত বন্ধুত্বকে উপেক্ষা করে অন্বেষাকে গোপনে গোপনে ভালবেসে ফেলি। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য এই যে, ওকে কোনদিনও সেকথা বলতে পারিনি। এই ভয়ে যদি বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভেঙ্গে যায়! তারপর কলেজের থার্ড ইয়ারের একদম শেষের দিকে অন্বেষা ইন্দ্র নামের একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার কয়েকদিন পর কলেজও শেষ হয়ে গেলো। অন্যান্য বন্ধুদের মতোই অন্বেষাও সম্পর্কের বাঁধন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করলো। সত্যি বলতে কলেজ পাশ করার পর আমিও ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কর্মসূত্রে আমেরিকা চলে যাই। এমন করে আরও চার বছর কেটে গেলো। আর এই চার বছর পর আজ এই রাতে একটি নাম না জানা জায়গায় নির্ঝুম গঙ্গার ঘাটে ওর সাথে আমার আবার দেখা। অন্বেষাকে প্রথমে দেখে অদ্ভুতই লাগছিলো। কেমন যেন হয়ে গেছে দেখতে। ভীষন রোগা দেখাচ্ছে আগের তুলনায়। কিন্তু যে জিনিসটা আমায় সবথেকে বেশী বিস্মিত করছে তা হলো ওর সাজ পোশাক। অন্বেষা একটা লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পরে আছে। মাথায় সোলার চূড়া। এছাড়া গলায় সোনার হার, হাতে সোনার চুড়ি, মাথার মাঝখান বরাবর সোনার টিকলি, নাকে নথ ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমি ওর দিকে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখেই হয়তো ও বললো, "কিরে, চিনতে পারিসনি আমায়? " আমি একটু ইতস্তত করেই বললাম, " না মানে তোকে এখানে এইভাবে দেখবো তা আমি একেবারেই আশা করিনি। " অন্বেষাও একটু গম্ভীর ভাবে বললো, " আমিও। " এই বলে ও আস্তে করে আমারই পাশে সিঁড়ির ধাপটাতে এসে বসে পড়লো। আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই বললাম, " কিরে তুই এখানে কি করছিস? "

 

"তুই যা করছিস, আমিও তাই করছি", কথাটা বেশ মজা করেই বললো অন্বেষা। 

 

" মানে! সত্যি বলতে আমি নিজেও জানিনা যে, আমি এখানে কি করছি, কি করে এলাম! কিচ্ছু জানিনা আমি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো আমি দেখলাম ওইদিকটাতে রাস্তার উপর শুয়ে আছি" বলে আমি যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই আঙ্গুল তুলে দেখালাম। অন্বেষা মৃদু হেসে বললো, " তুই এখনও সেই হাঁদারামটাই আছিস। আমেরিকাতে গেছিস ঠিকই কিন্তু ওখানকার সাহেবরা তোকে এতটুকুও পাল্টাতে পারেনি। "

 

- হাঁদারাম! কেন বলতো? 

 

- ও তুই ঠিক পরে জানতে পারবি। আচ্ছা সিগারেট হবেরে তোর কাছে? 

 

"হ্যাঁ থাকার তো কথা। দাঁড়া" বলে আমি আমার প্যান্টের পকেটের ভিতর হাতরাতে লাগলাম। বেশীক্ষন লাগলো না, প্যান্টের পকেট থেকে একটা সাদা ধবধবে সিগারেটের প্যাকেট বেড়িয়ে এলো। প্যাকেটটা কোনো কারণে দুমরে মুচড়ে গিয়েছে বটে কিন্তু দু একটা সিগারেট তখনও অক্ষত রয়ে গেছে। সিগারেটের প্যাকেটটা আমি অন্বেষার দিকে এগিয়ে দিলাম। ও একটা সিগারেট নিলো। তারপর আমিও একটা নিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে আমার আর ওর সিগারেটটাতে অগ্নিসংযোগ করলাম। সিগারেটে প্রথম টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অন্বেষা বললো, " কেমন আছিস অনিন্দ্য? " আমিও ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, " ভাল আছি। তুই কেমন আছিস? "

 

- এতক্ষণ ভাল ছিলাম না, তবে এই তোকে পেয়ে গেলাম এখন কিন্তু বেশ ভালো আছি।


MD SOHAG KHAN

107 Blog posts

Comments