স্বপ্ন

স্বপ্ন মানুষের জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

 

'বেনামা একটা চিঠি আসলো।' 

কলিং বেল বাজালে দরজা খুলে দিলাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, "একটা চিঠি আসছে আপনার।"

 

"এই যুগেও চিঠি! আমার নামে চিঠি আসবে কোথায় থেকে?"

জবাবে লোকটা বলে, "আপনি রানা সাহেব না? আমিতো মালেকা মঞ্জিলেই আসছি। সব লেখা এখানেই।"

 

"ঠিকানা সবই ঠিক আছে। কে লিখলো চিঠি।"

 

"স্যার, আমিতো জানি না। গলির দোকানে বসেছিলাম। একজন ছেলে আমার হাতে এই বেনামা চিঠি দিয়ে বললো আপনাকে দিতে। আর আমি এ এলাকায় নতুন। আমাকে পাঁচশত টাকা দিলো, তাই চলে আসলাম। এই নিন চিঠি।"

 

আমি বেনামা চিঠি হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গেইটে দারোয়ান নেই। পুরো বাড়িতে আমি ও মা থাকি। বাবা দেশের বাহিরে। চিঠি হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে আসলাম। কৌতূহল কাজ করছে চিঠি নিয়ে। আম্মা রুমে আসার সময় জানতে চেয়েছে, কে আসলো? 

জবাব না দিয়ে রুমে ঢুকেই চিঠিখানা খুলে নিলাম। একটা চিরকুট। 

তাতে লেখা, "প্রকৃতির যত রূপ আছে, সব গুলো মিলিয়ে যেমন সৌন্দর্য হবে, তেমনই মানুষ অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ প্রত্যাশায় দিন পার করছে। কখনো কাছে আসেনি, তাই বলে কখনো দূরেও রাখেনি। রেখেছে পরম যত্নে, দিন গুলো অপেক্ষায় কাটছে। কখনো সুযোগ হলে চলে এসো সাত সমুদ্র পারি দিয়ে। সেই আমি আজও অপেক্ষায় আছি খাগড়াছড়িতে। গ্রামের বাড়ি তাইন্দং জমিদার বাড়ি।"

 

চিঠি দেখে সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। কেউ আমাকে কেনো বেনামা চিঠি দিবে? আর আমি কখনো এমন স্থানের নামও শুনিনি। আর এই চিঠি পড়ে আমার মনের ভেতর অনেক আগ্রহ জাগলো। তাকে খুঁজে দেখতে হবে৷ 

আমি নিজের ল্যাপটপ নিয়ে ওই স্থানের নামে গুগলে চার্চ দিয়ে, তেমন কোন তথ্য পাইনি। খাগড়াছড়ি পৌঁছানোর পর জিজ্ঞেস করতে করতে চলে যাবো৷ 

 

পরেরদিন সকালে মা'কে বললাম, খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাচ্ছি। বাসা থেকে একাই বের হলাম। খাগড়াছড়ির বাসে করে চললাম অজানা সেই পথে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দিকে গাড়ি চলছে। নানান প্রশ্ন মনের ভেতর জেগে উঠলো। কে সে, যে এতদূর থেকে ডাকছে? আমিতো কখনো খাগড়াছড়ি যাইনি। 

 

আমার জন্যই কে'ই বা অপেক্ষা করবে! বেনামা চিঠি লিখলো কেনো? মোবাইলের যুগ এসেও চিঠি! 

গাড়ি করে মাটিরাঙ্গা পার হলাম। বাসের কন্ট্রাক্টর বলে, "ভাই কোথায় নামবেন?"

 

"আমি তাইন্দং যাবো জমিদার বাড়িতে।"

"তাহলে মাটিরাঙ্গায় নেমে যেতেন। সেখান থেকে তবলছড়ি পর্যন্ত যাবেন। বাকিটা পথ হেঁটে। পাহাড়ি এলাকায় মানুষও খুব কম।"

 

"গাড়ি চলে না? আর মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই?"

 

"খাগড়াছড়ি শহরের বাহিরে কোথাও নেট পাওয়া যায় না। আপনি এখানেই নেমে যান। মাটিরাঙ্গায় ফিরে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। সেখান থেকে চাঁদের গাড়ি করে তবলছড়ি।"

 

বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করছি অন্য বাসের জন্য। ৩টা বাজে মাটিরাঙ্গায় ফিরে আসলাম। সাড়ে ৩ টার গাড়ি করে তবলছড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। ৩০ কি.মি হবে হয়তো পথটা। তবলছড়ি আসার পরই দেখি চারদিক থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। কি করবো কিছুই বুঝলাম না৷ আযানের পরই যেনো পুরো বাজারের মানুষ শূন্য। গাড়ি থেকে নেমে কোনদিকে যাবো সেটাই ভাবছি। পুরাতন জমিদার বাড়ি কোথায় সেটাতো জানি না।

 

চাঁদের গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, "ভাই আমাকে তাইন্দং যেতে হবে। কী করে যাবো? আমি কিছুই চিনি না। পাহাড়ে নতুন আসছি।"

 

"আপনার আরো আগের গাড়িতে আসা দরকার ছিলো। শেষ গাড়িতে সব এখানের মানুষ আসে। তাইন্দং যেতে হলে আপনাকে আজকে কোথাও থাকতে হবে। সকাল ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। পাহাড়ের ভেতর জীব-জন্তুর ভয় আবার ডাকাতের কবলেও পড়তে পারেন।"

 

"রাতে থাকার মতো কোন হোটেল পাওয়া যাবে? ভালো হোটেল।"

 

"ভালো কিছু নেই। তবে বাজারের পাশে একজন আমার আত্মীয় আছে। চাইলে থাকতে পারেন।"

 

"ঠিক আছে।"

 

রাতটা একটা বাড়িতে কাটালাম। ড্রাইভার চলে গেলেন আমাকে দিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে ৯টা বেজে গেলো। সারাদিন গাড়িতে করে ক্লান্ত ছিলাম। তাই দেরি হলো। সকালের নাস্তা দিলো। বাড়ির কর্তা সকালেই কাজে চলে গেছে। বাড়িতে ১৪-১৫ বছরের একটা ছেলে আছে। 

আমি ডেকে বললাম, "তাইন্দং যেতে হলে কী করে যাবো?"

 

"দুপুরের ২টা বাজে গাড়ি আসে মাটিরাঙ্গা থেকে তখন গাড়ির যাত্রীদের সাথে চলে যাবেন। একা একা যাওয়া সম্ভব নয়।"

 

আমি দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। দুপুরের গাড়ি আসলে মানুষের সাথে হেঁটে চললাম তাইন্দং দিকে। মাটির রাস্তায় হাঁটার অনুভূতি অন্য রকম। তার উপর চারদিকে বনজঙ্গল। আমরা বিকাল তিন'টায় চলে আসলাম তাইন্দং। তাইন্দং বাজার তেমন বড় নয়। দু-একটা দোকান ঘর। একজন লোককে জমিদার বাড়ির পথটা দেখাতে বললাম। আমাকে বাড়ির রাস্তাটা দেখি দিলেন। আমি একাই হাঁটছি৷ কিছু দূর যাওয়ার পর একটা চায়ের দোকান দেখলাম। সেখানে একজন লোককে বললাম, "জমিদার বাড়িটা কোনদিকে?"

 

লোকটা আমাকে দেখেই দৌড়াতে শুরু করলো। যেনো ভুত দেখলো। আমি কিছু বুঝার আগে লোকটা ছুটছে। দোকানে আরো লোক বসে ছিলো। 

 

অন্য একজনকে বললাম। সে দেখিয়ে দিলো। আমি মেঠু পথ ধরে হাঁটছি। মিনিট দশেক পর জমিদার বাড়িতে এসে হাজির। চারদিকে বেষ্টনি দিয়ে রাখা। পুরাতন একটা জমিদার বাড়ি।

 

বাড়িতে কোন লোকজন দেখলাম না। যেনো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে৷ বাড়িতে প্রবেশ করলে কেউ চেচিয়ে বলছে, বাড়িতে কেউ আসলো নাকি? 

মেয়েটার মিষ্টি গলা। 

একবার দেখতে উঁকি দিলাম। 

 

একজন লোক এসে সামনে দাঁড়ালো। আমি দেখে বললাম, "দোকান থেকে দৌড়ে আসলেন কেন? সাথে নিয়ে আসতে পারতেন। কি হয়েছে এমন?"

 

লোকটা চুপচাপ রইলো। আমাকে বললো, "আপনি ঘরের ভেতর আসেন। মালিক ঘরেই আছেন।"

 

আমাকে নিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম। রাজার আমলের সেই বিলাসবহুল সব জিনিসপত্র। আমি ঘরের একটা দেয়াল দেখে থমকে গেলাম। সেখানে আমারই ছবি লাগানো। আমি নিজেকে যেনো আয়নায় দেখছি। 

 

লোকটা বলে, "আপনার ছবি। আমাদের রাজকন্যার আঁকা।"

 

নিজের ভেতর আগ্রহ আরো বেড়েই চলছে। কে সেই রাজকন্যা? আমার স্বপ্নের রাজকন্যা নয়তো! 

আমার ভাবনার ছেদ করলেন বৃদ্ধ একজন মানুষ এসে। আমাকে দেখে বলে, "তোমার নাম কি বাবা? তোমার সেই ছবি আজ অনেক বছর দেখে আসছি। আমার মেয়েটার আঁকা।"

 

"রানা। ঢাকা থেকে আসছি। এই বাড়ি দেখতে আসছি।"

 

যেটার জন্য আসছি সেটা নিয়ে আর বলা হয়নি। আমার ছবি দেখে কি বলবো কেবল এটাই ভাবছি। বৃদ্ধ লোকটা আবার নিজের রুমে চলে গেলেন।

 

কাজের লোক'টাকে বললাম, "আমার ছবি কি করে আঁকছে? আমিতো কখনো এই খাগড়াছড়িতেই আসিনি। আমার ছবি আকঁছে কি করে?"

 

"আমি জানি না সাহেব। আপনার কাছে আসছে সে। একটু অপেক্ষা করেন৷"

 

আমি চুপচাপ বসে রইলাম। একটা মেয়ে আসলো। বয়স ১৭-১৮ হবে৷ সাথে একটা কাজের মহিলা হবে। চেহারা আর পোশাকেই বুঝলাম এটাই জমিদারের মেয়ে। মেয়েটা একজনের উপর ভর করে আসছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

কাজের লোক'টা বলে, "৮বছর আগে একটা গাড়ি দূর্ঘটনায় জমিদার পরিবারের সবাই মারা যায়। আর সবার আদরের ছোটো মেয়ে বেঁচে গেলেও চোঁখ চিরতরে হারিয়ে ফেলে। ছোটো থেকেই ছবি আঁকার শখ। আজও এটা করেই সময় কাটায়।"

 

আমি কি বলবো কিছুই বুঝলাম না। যে মেয়ে ৮ বছর আগে থেকে অন্ধ। সে কি করে আমার ছবি আঁকে? আর আমাকে কখনো দেখেনি। যেহেতু ৮ বছর অন্ধ। আমাকে দেখে ছবি আঁকা অসম্ভব।

 

"আমি রানা। ঢাকা থেকেই আসছি। আমার ছবি আপনি আঁকছেন?"

 

"আমার নাম রিপা। আমি আপনাকে আগে দেখেছি। আমার সারাটা দিন আপনাকে নিয়েই কাটে৷ কিছুক্ষণ আগে যখন জানলাম আপনি আসছেন। সবার কথা মিথ্যা প্রমানিত হয়ে গেছে৷ সবাইকে আমি বললাম আপনি আছেন দুনিয়ায়। সবাই বললো আমার ভ্রম।"

 

"আমাকে আপনি কবে দেখেছেন?"

 

"অনেকদিন আগে। একদিন স্বপ্নে দেখেছি। সেই থেকে আমার মনের ভেতর আপনাকে একে ফেলছি। এইছবি গুলো দেখেন। আপনিতো? নাকি সবাই মিথ্যা বলছে।"

 

আমি তাঁর কথা শুনে কিছু বলতে পারছি না৷ আমার চুপচাপ থাকা দেখে রিপা বলে, "আপনি সেইজন যে আমার স্বপ্নের দুনিয়ায় রাজকুমার। আপনি সে যাকে নিয়ে আমার আলাদা একটা স্বর্গের ভেতর বসবাস।"

 

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আমি রিপাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার বুকের ভেতর অন্য একটা অনুভূতি বয়ে গেলো। আমি রিপার সকল প্রশ্নের একটাই জবাব দিলাম, "হয়তো এই ভালোবাসার জন্য এতদূর ছুটে আসলাম৷ আমিই সে, যাকে এত নিপুন ভাবে এঁকে রাখছো।"

 

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। রিপা আমার বুকে।

 

কাজের লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি রিপাকে সোফায় বসালাম। আমি দেখছি রিপাকে। এত সুন্দর মানুষ হয় জানতাম না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা এজন্য চোখের আলো কেড়ে দিয়েছে। দুনিয়া দেখাবে না, তাকে দুনিয়া দেখুক।

 

"রিপা তুমিই আমাকে চিঠি লিখে আসতে বলছো? আমার ঠিকানা কি করে পেয়েছো?"

 

"আমি চিঠি লিখবো কী করে? আমিতো আজকের আগে এটাও জানতাম না, আমার স্বপ্নের মানুষ'টা দুনিয়ায় আছে।"

 

কাজের লোকটা বলে, "সাহেব কয়েক মাস আগে কয়েকজন ছেলে আসে ঘুরতে। পুরো বাড়িতে ঘুরে। রিপা মা'র ছবি আঁকার কাহিনি শুনে। আঁকা ছবি গুলোর ক্যামেরায় ছবি তোলে নেয়। হয়তো তাদের কেউ আপনাকে বলছে।"

 

আমিও বুঝলাম হয়তো তাদের কেউ আমাকে খুঁজে বের করলো। এটা নিশ্চিত যে আমাকে রিপা জীবনে কখনো দেখেনি। 

আমার কাছে রিপার বাবা আসলো। আর বলেন, "আমার মেয়েটা অন্ধ। ছবি আঁকলে সব হয় না। তুমি কী বিয়ে করবে? আমি অনেক বিয়ের জন্য ছেলে আনছি। তোমার আশায় পথ চেয়ে বসেছিলো। আজকে তোমার জবাবের উপর তাঁর জীবন।"

 

আমি বললাম, "যার দুনিয়ায় আমি ছাড়া কেউ নাই। তাকে ছেড়ে আমি কী করে বাঁচবো। হয়তো আমার জীবনের সঙ্গী সে৷ তাই এতদূর আসা।"

 

রিপার বাবা বলেন, "আমাদের সকল জমিজামা সব তোমার। আমার বংশের একজনই আছে। আমার মেয়ে, আমার সব কিছু। সব সম্পদের মালিকও সে৷"

 

"আমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই৷ আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি ঢাকায় নিয়ে যাবো৷"

 

"যেভাবে ভালো আর কি। কালকে বিয়ের ব্যবস্থা করছি। তোমার পরিবারকে আসতে বলো।"

 

"এই পাহাড়ের ভেতর আসা সম্ভব নয়। তাই বিয়ে করেই নিয়ে যাবো।"

 

পরেরদিন পুরো গ্রামকে নিয়ে আমাদের বিয়ের কাজ শেষ হয়। আমাদের বিবাহের প্রথম দিন শুরু হয় রিপাদের বাড়িতেই। বাসর রাতে যেনো একটা চাঁদ দেখলাম আমার রুমে।

 

বিয়ের পরের দিন ঢাকায় ফিরে আসলাম। মা রিপাকে দেখে খুশী। আমাদের জীবনে কোন কিছুর অভাব নেই। রিপাকে নিয়ে আমার জীবন ভালোই চলছে। রিপা চোখ নেই, তবে আমার চোখেই রিপা দুনিয়া দেখে। বিয়ের কয়েকমাস পর একটা বেনামা চিঠি আসে। 

তাতে লেখা, "আল্লাহ ইচ্ছে জীবন শুরু করলেন। আমরা অনেক কষ্ট করে খুঁজে পেয়েছি তখন। প্রথম ছবির কথা শুনে, অবাক হয়েছিলাম৷ শেষে একদিন ভার্সিটির কাছে দেখে স্বপ্ন যে বাস্তব হয় সেইদিন বুঝেছিলাম। সব ঠিকানা নিয়ে চিঠি দিলাম। বেনামা চিঠিতেই প্রিয়জনকে পেয়েছেন। এটাই মনে রাখলে হবে, আমাদের চিনতে হবে না।"

 

রিপাকে নিয়ে আমার জীবন ভালোই চলছে। রিপা আমার জীবনটাই স্বর্গ বানিয়ে দিলো। সবাই দোয়া করবেন। যেনো বাকিটা জীবন ভালোবাসায় বেঁচে থাকি ।

 

নিলাশাকে দেখার পর থেকে তার মায়াবি মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। তার রূপ পরীর চেয়ে কোন অংশে কম না। এক কথায় ডানাকাটা পরী। তাকে প্রথম দেখাতেই বিয়ের জন্য হ্যাঁ করে দিয়েছি।

 

এরকম সুন্দরী বউ পেলে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে করবে যে কেউ। আর আমি সে সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিব, তাতো হয় না। ভাবতেই শিউরে উঠছি বারবার। হঠাৎই আমার পা দুটো কেউ জড়িয়ে ধরায় ইষৎ চমকে পায়ের দিকে তাকালাম। 

 

ছোটভাই রাকিব আমার পা ধরে আছে। চোখ ছলছল করছে তার। রাকিবের এমন আচরণে অবাক হয়ে আমি বললাম, 'কিরে কী হয়েছে তোর?'

রাকিব আরো শক্ত করে আমার পা জড়িয়ে ধরলো দু হাতে। তারপর ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল, 'ভাইয়া তুমি এমনটা কইরো না। তুমি এমনটা ভুলেও কইরো না প্লিজ।'

 

ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি। মাথায় ঘুরছে, ভাবছি, আমি আবার কী করলাম! শান্তস্বরে তাকে বললাম, 'আমি আবার কী করেছি? আর তুই এভাবে আমার পা ধরে রেখেছিস কেন?'

'নিলাশার সাথে আমার আজকে চার বছরের সম্পর্ক। তুমি প্লিজ, ওরে বিয়ে কইরো না।'

 

রাকিবের কথা শুনে থম মেরে গেলাম আমি। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম পুরোপুরি। কী বলে এ ছেলে! তাকে আমার থেকে আলাদা করে বসা থেকে উঠে দাঁড় করালাম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, 'ভীষণ ভালোবাসিস তাকে, না?'

'অনেক বেশি ভালোবাসি ভাইয়া। প্লিজ, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট কইরো না। দোহায় লাগে তোমার।'

'আরে ভাই আমার। কান্না করছিস কেন? আমি না তোর বড়ভাই! ছোট ভাইয়ের কষ্ট কিভাবে দেখব আমি? আচ্ছা নিলাশাকে তুই-ই বিয়ে করবি। ওর সাথে তোরই বিয়ে হবে...'

'সত্যি?' রাকিব আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তার পিঠ চাওড়ে দিতে লাগলাম। হাসিমুখে বললাম, 'পাগল ভাই আমার।'

 

 

অনেক কলে-কৌশলে রাকিব আর নিলাশার বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম। আজ তাদের দুজনের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। প্রাইভেট কারে করে নিলাশাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে রাকিব। যাওয়ার সময় হাসিমুখ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমিও মুখে হাসি নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি দুজনকে। দুজনে আজ থেকে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখছে। যদিও সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা বলার অবকাশ রাখে না। ভাবতে ভাবতে বিয়ে বাড়ির দিকে তাকালাম আমি৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম। একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।

 

আর অমনি সেলফোনটা বেজে উঠার শব্দে কিঞ্চিৎ অবাক হলাম আমি। মুখে বিকৃত হাসি ফুটিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করলাম। স্কিনে তাকাতেই হাসিটুকু আরো বেশি চওড়া হলো। রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, 'বস কাজ হয়ে গেছে।'

 

কথাটা শোনার পর চুপচাপ কল কেটে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম। চোখমুখ হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমার। আর ঠিক তখনি আরো একবার ফোনের রিং বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে সাথে সাথে রিসিভ করে নিলাম। কানে লাগাতেই কারো উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। সে চিৎকার করে বলতে লাগল হন্তদন্ত হয়ে, 'হ্যালো হ্যালো শুনছেন?'

'হ্যাঁ, বলুন!'

'এখানে সর্বনাশ হয়ে গেছে। একটা ট্রাক সাদা রংয়ের প্রাইভেট কারকে পিশে দিয়ে চলে গেছে। গাড়িতে থাকা সবাই মারা গেছে। তাদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম রাকিব!'

 

কথাটা শোনার পরেই লাইন কেটে গেল। আমি থম মেরে নিজ জায়গায় বসে রইলাম। মুখস্রী জুড়ে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। তাহলে প্ল্যান কাজে দিয়েছে। বিয়ের তিনদিন আগে শুনেছি—নিলাশা মেয়েটি আমার ভাই রাকিবসহ আরো তিনজনের সাথে সম্পর্কে জড়িত ছিল। তার চরিত্র ভালো নয়। সেইসাথে তার পূর্বে বিয়েও হয়েছিল।

 

স্বামী খুন হয় কোন এক অজ্ঞাত ভাবে। যার সমাধান আজও পাওয়া যায়নি। হয়তো মেয়েটাই তার স্বামীকে মেরে ফেলেছিল। এ অবস্থায় রাকিবকে তার হাতে কী করে তুলে দিতাম আমি? আর নিলাশাকে ছাড়া রাকিব বাঁচবেও না। তাই দুজনকে একত্র করে দিয়েছি। আজন্মের জন্য। সবই হয়েছে প্ল্যান মোতাবেক, হা হা হা! 

 


Tanvir Arafat

93 Блог сообщений

Комментарии

📲 Download our app for a better experience!