“স্যার এই নিন চাবি” সুব্রত চাবির গোছা এগিয়ে দিলো। চাবি নিয়ে রাজশেখর বললেন “তুমি ছাড়া এই বাড়িতে আর কে কে আছে কাজ করা দেখাশোনা করার জন্য? ”
“আমিই আপাতত কেয়ারটেকারের ভূমিকা পালন করছি। চম্পা আর গৌর এই বাড়ি ঝেড়ে পুঁছে গুছিয়ে রাখে। যারা পিকনিকের জন্য আসে চম্পা তাদের রান্নাবান্নাও করে দেয়। তবে রাতে কেউ থাকে না তো আমরাও কেউ রাতে থাকি না। সন্ধ্যের মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে যাই। আমাদের বাড়ি অবশ্য খুব দূরে নয়। এই বাড়ির বাউন্ডারির ঠিক বাইরেই কিছু ঘর আছে সেখানেই থাকি। আসলে বাড়ির যিনি প্রথম মালিক ছিলেন তিনি এই ব্যবস্থাই করেছিলেন”
“ঠিক আছে। তোমাকে ডাকলে যাতে পাওয়া যায় তার কি কোন ব্যবস্থা আছে? ”
“হ্যাঁ আছে স্যার। যে ঘরে আপনারা শোবেন সেই ঘরে একটা দড়ি ঝুলতে দেখবেন। সেটা টানলে আমার ঘরের ঘণ্টাটা বেজে উঠবে, আমি জানতে পারবো আপনারা ডাকছেন”
“তুমি তো আমাকে সেই আদ্যিকালের গল্প শোনাচ্ছ। তোমার মোবাইল নেই যাতে ফোন করলে তুমি জানতে পারবে? ”
“হ্যাঁ আছে স্যার। তবে বুঝতেই তো পারছেন গ্রামাঞ্চল তো সন্ধ্যার পর ভালোভাবে টাওয়ার কানেকশন পাওয়া যায় না”
“ওঃ ঠিক আছে। তা তুমি কি এখনি চলে যাবে? ”
“তা কেন স্যার। আপনারা রাতে কি খাবেন সেটা বলে দিলে চম্পাকে দিয়ে বানিয়ে ঘণ্টাখানেক পরে এসে পৌঁছে দিয়ে যাবো”
রাজ ওর বন্ধু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন “কি হে রাতে কি খাবে? এরকম ব্যাপার জানলে খাবার কিনেই নিয়ে আসতাম আসার পথে”
অনি বললেন “আরে অত চিন্তা কীসের। ও তো বলছে রান্না করিয়ে দিয়ে যাবে”
“তাহলে বলো কি খাবে? ”
“বেশি আর কি লুচি আর পাঁঠার কষা মাংস, আর একটু গা গরম করার পানীয়” তারপর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল “কি হে হবে তো? ”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিই নিয়ে আসবো”
“ঠিক আছে তাহলে এসো। আমরা একটু ঘুরে দেখি বাড়িটা কেমন। আর যে ঘরে শোব তা কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছো তোমরা”
সুব্রত চলে যাওয়ার পর রাজ আর অনি নীচের ড্রয়িংরুম থেকে পায়ে পায়ে উঠে আসে দোতলায়। পুরনোদিনের জমিদারদের বাড়ি গঙ্গার পাড়ে। এক কালে নাকি জমিদাররা এখানে থাকতো তারপর কোন এক পুরুষ শহরের দিকে বাড়ি করে ওখানে সপরিবারে চলে যান। তারপর থেকে বাড়িটা পড়ে ছিল। কয়েক পুরুষ পর এক ছেলে যে বর্তমানে বাড়ির মালিক বাড়িটা ভাড়া দিচ্ছেন পিকনিক করার জন্য। এতো বড় বাড়ি দেখাশোনা করে রাখার খরচ প্রচুর। বাড়ি ভাড়া দিলে কিছু টাকা তো উঠে আসে। তাই এই ব্যবস্থা।
বাড়ির ভেতরে পা দেওয়ার পর ওদের দুজনেরই মনে হচ্ছিলো যেন সত্যি জমিদার আমলে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ওদের ঘরে এসে উপস্থিত হলেন ওরা দুজনে। বেশ উঁচু রাজকীয় খাটে শুভ্র সফেন বিছানা পাতা। তার সাথে বালিশ কোলবালিশ, সব আছে। ঝাড়বাতিটা জ্বলছে, এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পাখার সুইচ দিতে পাখা বেশ জোরে ঘুরতে শুরু করলো। ওরা ঘরের লাগোয়া বাথরুমে এক এক করে ফ্রেশ হয়ে এলেন। রাজ দোতলার লাগোয়া বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুললেন। কিন্তু দরজা খুলল না। বেশ চাপ দিতে হল ওটাকে ঠেলে খুলতে। অবশ্য দরজা খুলে যেতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এলো ঘরে। ততক্ষণে বাথরুম থেকে অনিও বেরিয়ে এসেছেন। বললেন “রাজ তোমার জন্য একদিনের জন্য নিজেকে জমিদার বাড়ির সদস্য মনে হচ্ছে”
রাজ হাসলেন “তবেই বল, তুমি তো ভাই আসতেই চাইছিলে না”
“তখন কি আর বুঝেছি এতো সুখ কপালে নাচছে”
হঠাৎ দরজায় এসে উপস্থিত হল সুব্রত। বলল “স্যার আপনাদের খাবার নিয়ে এসেছি। নীচে ডাইনিঙে খাবেন না এখানে দিয়ে যাবো”
“নীচেই চলো, বিছানায় বসে কি আর খাওয়া যায়? ”
“চলুন” বলেই সুব্রতর চোখে পড়লো বারান্দার দিকে খোলা দরজার ওপরে, বলল “এটা কে খুলল? ”
রাজ উত্তর দিলেন “আমি। ঘরের গরম হাওয়াটা বেরিয়ে যাবে”
সুব্রত আর কোন কথা ও বিষয়ে না তুলে বলল “তাহলে আসুন নীচে। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি”
নীচে ডাইনিঙে এসে ওদের চক্ষু ছানাবড়া। যা বিশাল এক ডাইনিং টেবিল পাতা মনে হয় একসাথে জনা তিরিশ লোক বসে খেতে পারবেন। তবে অত লোক এখন না খেলেও টেবিল কিন্তু আগের আমলের মতোই সাজানো। ওরা দুজন এসে মুখোমুখি বসতেই সুব্রত খুব সুন্দর করে সব সাজিয়ে দিলো। তারপর বসে বসে খাওয়া তদারকিও করলো। খাওয়া শেষ করে উঠতে ও বলল “আপনারা হাত ধুয়ে বসার ঘরে আসুন আপনাদের পানীয় ঢেলে দিচ্ছি”
দুজনে এসে বসতে সুব্রত পরিমাণ মতো সব মিলিয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলো দুজনের দিকে। রাজ বললেন “অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। অনেক করেছ আমাদের জন্য। আর থাকতে হবে না। রাত তো অনেক হল এবার তুমি এসো। দরকার পড়লে তোমাকে পাবো তো? ”
“হ্যাঁ স্যার পাবেন। আমি আসি তাহলে। শুভরাত্রি” সুব্রত চলে গেলো। ওরা একটু করে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন আর গল্প করছেন। হঠাৎ অনি বললেন “বুঝলে রাজ সব ব্যবস্থা যখন করলে তখন জমিদারের নাচঘরের বাইজির ব্যবস্থাও করতে আরও আনন্দ পেতাম। কোনদিন তো সামনে থেকে ওসব দেখার সুযোগ ঘটলো না”
“হুম এটা বেড়ে বলেছ কিন্তু আগে বললে হত এখন আর কি হবে”
“সুব্রতকে বললেই হত”
“ও কি এতো তাড়াতাড়ি এর ব্যবস্থা করতে পারতো, মনে হয় না”
“আহা ওই চম্পা না কে ও’ই আসতে পারতো আমাদের মনোরঞ্জন করতে”
এই গল্পের মাঝেই হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলো। রাজ বললেন “যাহ্ লোডশেডিং! সুব্রত তো আগে বলেনি যে আলোও হঠাৎ হঠাৎ যেতে পারে। নাহলে ওকে দিয়ে দু তিনটে মোম আনিয়ে রাখতাম”
“হুম! এরকম বাড়িতে আলো চলে গেলে কেমন যেন অনুভূতি হয়”
“কি হে তোমার ভয় করছে নাকি? ”
“ঠিক ভয় নয়”
“তুমি সেই আগের মতোই ভীতু রয়ে গেছ জানতাম না” কথার মাঝে কীসের যেন শব্দ হল ঘরের মধ্যে। অনিমেষ জিজ্ঞেস করলো “কীসের শব্দ ওটা? ”
“কোথায় শব্দ? ”
“তুমি শুনতে পাচ্ছ না? কিন্তু আমি যে পাচ্ছি ঘুঙুরের শব্দ”
“কোথায়? ”
“ওই শোন” এবার রাজও শুনতে পেলেন। অন্ধকারের মধ্যে দুজনেই এদিকওদিক তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন শব্দের উৎস কোথায়। খানিক অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্ধকার যখন চোখে ষয়ে এলো তখন দুজনেই দেখতে পেলেন এক সাদা পোশাক পরা মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নীচে আসছে। আর ওর নামার তালে তালে নুপুরের আওয়াজ উঠছে। দুজনেই চমকে উঠলেন। সুব্রত তো বলেছিল এ বাড়িতে কেউ থাকে না তাহলে এই মহিলা এলো কোথা থেকে। মহিলা এগিয়ে এলো কাছে। রাজ ভয়কে পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কে আপনি? ” কিন্তু প্রশ্ন করতে করতেই টের পেলো ওর নিজেরই আওয়াজ অত চেষ্টার পরেও কেঁপে উঠলো। মহিলার হাসি শোনা গেলো। “সে কি তোমরা নর্তকীকে আহ্বান করলে আর এখন চিনতে পারছো না? ”
“তোমাকে কে ডাকলো, আমরা তো ডাকিনি”
“ডেকেছ তো। তা কি নাচ দেখবে, কত্থক নাকি আধুনিক কিছু”
“তুমি যাও তোমায় আমরা ডাকিনি”
“এখন ডাকোনি কিন্তু তখন তো ডেকেছিলে আর আমি আমার শিশু সন্তানকে ছেড়ে আসতে চাইনি বলে জোর করে ধরে এনেছিলে। আর যাতে ভবিষ্যতেও একই সন্তানের দোহাই না দিতে পারি তাই ওকে মেরেই দিলে”
“কি সব বলছ আজগুবি, আমরা তোমাকে চিনিই না”
“চেনো চেনো। তোমাদের রক্তে আছে নারীদের নিয়ে ফুর্তি করা বদমায়েশি করা আর তোমাদের কথামতো না চললে তাদের পৃথিবী থেকেই হাপিস করে দেওয়া। সেই দুষিত রক্ত এখনো শরীরে বয়েই চলেছে তাই তো এতদিন পরেও এ বাড়িতে এসেই নর্তকীর কথা মনে পড়লো। সেবার ক্ষমতার অভাবে প্রতিশোধ নিতে পারিনি। এবার তো ছাড়া যায় না” বলেই দুটো হাত এগিয়ে গেলো দুজনের গলা লক্ষ্য করে। এতটাই আকস্মিক আর এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো সব কিছু যে ওরা পালানোরও সুযোগ পেলো না। সুব্রত সুব্রত করে আওয়াজ তুলতে চেষ্টা করেছিলেন রাজ কিন্তু গলায় স্বর ফুটলো না।
ওদিকে আঙ্গুলের চাপ বেড়ে চলল গলার ওপর। দুহাতে ধরেও ছাড়ানো গেলো না। অনি আর রাজ দুজনের কথাই আটকে গেলো। দুজনেই গোঁ গোঁ করতে লাগলো, কিন্তু গলার ওপর চেপে বসা হাত দুটোকে ছাড়াতে পারলো না। খানিক পরে দুজনেই গড়িয়ে পড়লো মাটিতে।
কিছুদিন পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করলো পচে গলে যাওয়া দুটি দেহ। অফিসার শুধু ভাবলেন এরা এখানে এলেন কি ভাবে।
ছুটতে ছুটতে এসে এইটুকু বলেই হাঁফাতে থাকে ইসমাইল।
সবাই বলে স্কুল মাস্টারী সবথেকে সুখের চাকরি। সে যে কত সুখের চাকরি, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন হলধরবাবু। ইউনিট টেষ্ট, মিডডে মিল, তারপরে এটা আবার বোর্ডিং স্কুল; সবসময়েই কাজের চাপ। সামনের সপ্তাহে ছেলের বিয়ে তাও ছুটি পাননি। ফোনেই গিন্নির সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে নিচ্ছিলেন। কথার মাঝে ইসমাইল এসে পড়ায় বাধ্য হয়ে কথা থামাতে হল।
হেডস্যার যে যথেষ্ট রাগী সে কথা সব ছাত্ররাই জানে। হলধরবাবু তাঁর রাগী গম্ভীর গলাতে ইসমাইলকে শুধান,
-কি হলো, মাঠে বাঘ বেরিয়েছে নাকি! এমন ছুটতে ছুটতে আসার কি হলো?
তখনও হাঁফাচ্ছে ইসমাইল। দুটো ঢোক গিলে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,
-নতুন ছেলেটা....
এইটুকু বলেই থেমে যায় ইসমাইল।
-নতুন ছেলেটা কি করেছে?
এক ধমক লাগান হলধরবাবু।
এবার আঙুল তুলে পুরনো হোস্টেলবাড়িটার দিকে আঙুল তোলে ইসমাইল। বলে,
-ওখানে ঢুকেছে ছেলেটা।
আঁতকে ওঠেন হলধরবাবু।
-তোরা ছেলেটাকে বলিসনি, ওখানে কারও ঢোকা বারণ আছে।
-আমরা কেমন করে জানব মাস্টামশাই যে ও ওখানে ঢুকবে। আমরা সবাই মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। হঠাৎ দীনেশ খেয়াল করে ছেলেটা দোতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই ওকে ওখান থেকে চলে আসতে বললাম কিন্তু ও ভেতরে ঢুকে গেল। এখনও বেরিয়ে আসেনি!
হলধরবাবু আজ প্রায় উনিশ বছর আছেন এই স্কুলে। তখন ঐ বিল্ডিংটাই ছাত্রদের হোস্টেল ছিল। সেবার এক কালবৈশাখী ঝড়ের রাতে বাজ পড়ে হোস্টেলের একটা অংশ পুরো ভেঙে পড়ে। কয়েকজন ছাত্র মারাত্মক রকমের আহত হয়েছিল। মারা গিয়েছিল একজন ছাত্র। মুখটুকু বাদে শরীরের একটা অংশ বিশ্রীভাবে ঝলসে গিয়েছিল।
আজ বারো বছরের বেশি হয়ে গেল, এখনও সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে শিউড়ে ওঠেন হলধরবাবু।
তারপর বছর খানেক ঐ বিল্ডিং অমন অবস্থাতেই পড়ে না। হোস্টেলের ছেলেদের স্টাফ কোয়াটার্সে সরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর থেকে যতবার ঐ বিল্ডিং সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে, একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। দোতলা অবধি তো কেউ পৌঁছাতেই পারেনি। শেষ অবধি ভূতুড়ে বিল্ডিং নাম নিয়ে বিল্ডিংটা ভাঙাচোরা অবস্থাতেই পড়ে আছে।
ঐ নতুন ছেলেটা তো সদ্য কদিন হলো ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছে। ওর বাবা-মা দুজনেই কিভাবে যেন মারা গেছে। জ্যাঠা এসে ভর্তি করে দিয়ে গেছেন। উনি বলেছিলেন অবশ্য, ছেলেটি বড়ো দুরন্ত। কিন্তু এই ক'দিনে তো ছেলেটিকে বেশ চুপচাপই মনে হচ্ছিল। আর ভেবে কি হবে! এখন ভালোয় ভালোয় ঐ ছেলেকে ভূতুড়ে বিল্ডিং থেকে বের করে আনতে পারলে হয়। নাহলে কি কৈফিয়ত দেবেন ওর বাড়ির লোকের কাছে! শুধু কি বাড়ির লোক! পান থেকে চুন খসলেই পার্টি থেকে মিডিয়া, কেউ ঝাঁপিয়ে পড়তে বাকি থাকবে না।
স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন বিকালেই তো ছেলেরা ঐ মাঠে খেলা করে। ঐ ছেলের এই সন্ধের মুখে ঐ ভাঙা বিল্ডিংএ ঢোকার কি দরকার পড়ল কে জানে! আজকালকার ছেলেপিলেগুলোই বড্ড বেয়ারা। আর দেরি না করে ইসমাইলের সাথেই ঐদিকে পা বাড়ায় হলধরবাবু।
অন্য ছেলেরা সব মুখ কাঁচুমাচু করে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হলধরবাবু বিল্ডিংএর দিকে এগোতে গিয়েও থমকে যান। গতবার এক মিস্ত্রি জোর করে ঢুকেছিল বিল্ডিংএ, ঘরের জিনিসপত্তর বের করে আনবে বলে। কিন্তু কি হলো, সবার চোখের সামনে সুস্থ মানুষটা মুখে রক্ত উঠে মরে গিয়েছিল। ডাক্তার ডাকার সময়টুকু অবধি পাওয়া যায়নি।
খানিক পিছিয়ে আসেন হলধরবাবু।
-যা তো, স্টাফ কোয়াটার্স থেকে স্যারদের ডেকে নিয়ে আয়।
হলধরবাবু ছাড়াও আর দুজন স্যার থাকেন এখানে। একা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার থেকে সবাই মিলে ভেবে কাজটা করাই ভালো। হলধরবাবুর মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতে দুজন ছেলে ছুট লাগায়। হলধরবাবু হাঁক পাড়েন,
-রামদীনকেও ডেকে আনবি।
স্কুলের দারোয়ান কাম নাইট গার্ড রামদীন। পেটানো চেহারা, ভয়ডরও খুব একটা নেই। এমন সমস্যায় তো রামদীনের মতো মানুষকেই সাথে দরকার।
ছেলেটা ভিতরে কি করছে কে জানে! সাড়াশব্দও তো নেই। মরে ফরে গেল না তো!
-না স্যার মরিনি, এই তো আমি।
চমকে ওঠেন হলধরবাবু। আরে ভূতের মতো দুম করে এ ছেলে উদয় হলো কোথা থেকে? এখনি তো সামনে কেউ ছিলনা। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দিয়েই জিজ্ঞাসা করেন,
-এই বিল্ডিংএ কেন ঢুকেছিলে! তুমি জানো না এখানে ঢোকা বারণ?
-কেন স্যার কি হয়েছে এই বিল্ডিংএ?
ছেলেটার কথায় কি ছিল কে জানে, কোন প্রতিবাদ করতে পারেন না হলধরবাবু। তার বদলে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা ব্যাখ্যা করতে লাগেন।
-ছেলেটা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল স্যার?
বারো বছর আগের সেই ঝলসানো মৃতদেহটা আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলধরবাবুর। এতো বছর পরেও যেন ভয়ে শিউড়ে ওঠেন উনি।
সামনে দাঁড়ানো নতুন ছেলেটাকে হাসতে দেখে মাথায় আগুন জ্বলে যায় হলধরবাবুর। বাজখাঁই গলাতে জিজ্ঞাসা করেন,
-হাসির কি হলো?
ছেলেটা তার পুলওভারটা খুলে ফেলে। দেখুন তো স্যার, এর থেকেও বেশি পুড়েছিল?
চমকে ওঠেন হলধরবাবু। কি বীভৎসভাবে পোড়া শরীরের বামদিকটা। এতো সেই বারো বছর আগের বাজ পড়ে ঝলসে যাওয়া ছেলেটাকে দেখছে মনে হচ্ছে। আকাশে মেঘ তো ছিল না, তবু খুব জোরে বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন। কাছাকাছি কোথাও বোধহয় বাজ পড়ল।
ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে হলধরবাবুর। উনি পিছন দিকে জোরে ছুটতে লাগেন। ঐ তো বঙ্কিমবাবু আর দয়ালবাবু আসছেন।
দয়ালবাবুই জিজ্ঞাসা করেন,
-ছেলেরা কি বললো, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। কে ঢুকেছে ঐ ভূতুড়ে বিল্ডিং এ?
বঙ্কিমবাবু বলছেন,
-ওরা বলছে নতুন ছেলেটা নাকি ঐ ভূতুড়ে বিল্ডিংএ ঢুকেছে। কিন্তু ওর জ্যাঠা আমার মোবাইলে ফোন করেছিলেন, ওর ঠাকুমা অসুস্থ তাই ওকে নিতে আসবেন আগামীকাল। ছেলেটাকে আমার ঘরে ডেকে পাঠিয়ে সেই কথাটাই বলছিলাম। ওতো আমার ঘরেই ছিল।
আপনি নিজে দেখেছেন? এই ছেলেদের কথার কোন ঠিক আছে নাকি কি দেখতে কি দেখেছে।
-আকাশে এমন মেঘ করেছে এখনও খেলা! খেললেই হবে, পড়তে বসতে হবে না! এখনি যে যার ঘরে গিয়ে ইংরাজী বই নিয়ে বসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি।
দয়ালবাবুর বকুনিতে ছেলেরা সবাই হৈহৈ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে হোস্টেলের দিকে।
ছেলেরা কি দেখতে কি দেখেছে হতে পারে। কিন্তু হলধরবাবু একটু আগে নিজে যা দেখেছেন, তা ভুলবেন কি করে! কিন্তু সেকথা বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কাউকে কিছু না বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান হলধরবাবু। মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, ছুটি না পেলেও কাল সকালেই মেডিকেল লিভ নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।
আর মাত্র তিনবছর চাকরি আছে। গিন্নীর কথা মতো, এবার বাড়ির কাছাকাছি ট্রান্সফার নেওয়ার চেষ্টাটা করতেই হবে।