অনুমান বিজ্ঞান

তার ব্যবস্থামত পরদিন দেখা করলাম এবং ২২১বি, বেকার স্ট্রীটের ঘরগুলি দেখলাম। দুটো আরামদায়ক

তার ব্যবস্থামত পরদিন দেখা করলাম এবং ২২১বি, বেকার স্ট্রীটের ঘরগুলি দেখলাম। দুটো আরামদায়ক শয়ন-কক্ষ, একটি বড় খোলামেলা সুসজ্জিত বসবার ঘর, তাতে দুটো প্রশস্ত জানালা দিয়ে প্রচুর আলো এসে পড়ছে। সব দিক থেকেই বাসাটা ভাল এবং সম-অংশে ভাড়াটাও ন্যায্য বলেই মনে হয়। কাজেই সেখানেই কথাবার্তা পাকা করে সঙ্গে সঙ্গে বাসার দখল নিয়ে নিলাম। আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে সেখানে গেলাম। শার্লক হোমস পরদিন সকালে কয়েকটা বাক্‌স্‌ ও পোর্টম্যাণ্টো নিয়ে হাজির হল। মালপত্র খুলে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে দু’ একদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে দুজনেই নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম।

 

হোমসের সঙ্গে একত্রে বাস করা মোটেই কঠিন নয়। লোকটি চলা-ফেরায় শান্ত, স্বভাবে পরিমিত। রাত দশটার পরে কদাচিৎ জেগে থাকে, আর সকালে আমার ঘুম ভাঙবার আগেই প্রাতরাশ সেরে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখনও সারাটা দিন কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাটায়। কখনও বা ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে। আবার অনেকদিন শহরের অনুন্নত এলাকাগুলিতে দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ায়। কাজের নেশা যখন পেয়ে বসে তখন কোন কাজেই সে পিছপা নয়। কখনও বা সম্পূর্ণ উল্টো। দিনের পর দিন বসবার ঘরে সোফায় বসে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মুখে একটা কথা নেই, শরীরের একটু নড়ন-চড়ন নেই। সেসময় তার চোখে এমন একটা ফাঁকা স্বপ্নময় দৃষ্টি দেখেছি যাতে অনায়াসেই সন্দেহ হতে পারত যে নেশাখোর; কিন্তু তার সংযত ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা দেখে সে ধারণা মনেও ঠাঁই পেত না।

 

যতদিন কাটতে লাগল, তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার কৌতূহল ততই বাড়তে লাগল। তার শরীর এবং চেহারাই এমন যে যে-কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। লম্বায় ছ’ ফুটের উপরে, কিন্তু এতটাই কৃশকায় যে আরও ঢ্যাড়া মনে হয়। যে নেশার ঘোরের কথা এইমাত্র উল্লেখ করেছি সেসময়টা ছাড়া সাধারণভাবে তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। বাজপাখির মত সরু নাক, সারা মুখে সদা-সতর্কতা ও স্থির সিদ্ধান্তের আভাষ ফুটিয়ে তোলে। তার মোটা চৌকো থুতনি দৃঢ় চরিত্র মানুষের লক্ষণ। তার দুই হাতে সব সময়ই কালি আর কেমিক্যালের দাগ লেগে থাকত। তা সত্ত্বেও কোন কিছু ছোঁবার বেলায় সে খুবই খুঁতখুঁতে। কাজের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করবার সময় তার এই স্বভাব আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি।

 

এই মানুষটি আমার কৌতূহলকে কতখানি জাগ্রত করেছিল, এবং নিজের সম্পর্কে তার নীরবতাকে ভাঙবার কতটা চেষ্টা আমি বারবার করেছি, সেকথা বললে পাঠক নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চার অপরাধে আমার নিন্দা করবেন; কিন্তু তা করবার আগে মনে রাখতে হবে যে সেসময় আমার জীবন ছিল লক্ষ্যহীন এবং করবার মত কোন কাজও তখন আমার হাতে ছিল না। আমার স্বাস্থ্যের তখন যা অবস্থা তাতে আবহাওয়া অত্যন্ত ভাল না থাকলে আমি বাইরেও বেরোতে পারতাম না। এমন কোন বন্ধুও ছিল না যার সঙ্গে কথা বলে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিকে কাটাতে পারি। সে অবস্থায় এই সঙ্গীটিকে ঘিরে যে ছোটখাট রহস্য ছিল তার সমাধানের চেষ্টায়ই আমি অনে সময় কাটিয়ে দিতাম।

 

সে ডাক্তারি পড়ত না। এবিষয়ে স্ট্যামফোর্ড যা বলেছিল আমার একটা প্রশ্নের উত্তরে সে নিজেও সেই উক্তিই সমর্থন করেছে। সে নিয়মিতভাবে এমন কোন পড়াশুনা করে না যাতে সে বিজ্ঞানের একটা ডিগ্রি পাবার উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে, অথবা জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশের অন্য যে কোন দ্বার-পথ তার সামনে উন্মুক্ত হতে পারে। কিন্তু কোন কোন পাঠ্য বিষয়ে তার উৎসাহ এতই উল্লেখযোগ্য, এবং খামখেয়ালের দ্বারা সীমিত হলেও তার জ্ঞান এত অসাধারণভাবে প্রচুর ও সূক্ষ্ম যে তার অনেক বক্তব্যই আমাকে বিস্মিত করেছে। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্মুখে না থাকলে কোন মানুষ এত কঠিন পরিশ্রম করতে বা এত নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। যারা আবোলতাবোল পড়াশুনা করে তাগের জ্ঞান কদাচিৎ সঠিক হয়ে থাকে। স্পষ্ট কারণ না থাকলে কোন মানুষ ছোটখাট বিবরণ সংগ্রহ করে মনকে বোঝাই করে রাখতে পারে না।

 

তার অজ্ঞানতাও তার জ্ঞানের মতই উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সাহিত্য, দর্শন বা রাজনীতির সে প্রায় কিছুই জানে না। টমাস কার্লাইল থেকে উদ্ধৃতি দেওয়াতে সে খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করে বসল, লোকটি কে এবং কি করতেন। কথাপ্রসঙ্গে যেদিন বুঝতে পারলাম যে সে কোপার্নিকাসীয় মতবাদ এবং সৌর জাগতিক গ্রহনক্ষত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেদিন আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে—এই বিংশ শতাব্দীতে কোন সভ্য মানুষ যে সেটা জানে না সে কথা আমি ভাবতেই পারি নি।

 

আমার মুখে বিস্ময়ের ভাব লক্ষ্য করে সে বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি এতে বিস্মিত হয়েছ। কিন্তু ও তথ্যটা জানবার পরে মনে হচ্ছে, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব ওটা ভুলে যেতে।‘

 

‘ভুলে যেতে!’

 

সে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল, ‘দেখ, আমি মনে করি মানুষের মস্তিষ্ক গোড়ায় একটা ছোট শূন্য চিলেকোঠার মত। সেখানে পছন্দসই আসবাব জমানোই উচিত। একমাত্র বোকা লোকই যা কিছু পায় তাই সেখানে জমা করে। ফলে যে জ্ঞান তার পক্ষে দরকারী সেইটেই হয়ে ভীড়ে হারিয়ে যায়, না হয় অন্য সব জিনিসের সঙ্গে এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে যায় যে দরকারের সময় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের কুঠুরিতে কি রাখবে না রাখবে সেবিষয়ে দক্ষ কারিগর কিন্তু ভারী সতর্ক। কাজের জন্য দরকারী যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু সে সেখানে রাখে না। আর সে যন্ত্রপাতিও সংখ্যায় অনেক বলে সেগুলিকে সে বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। ঐ ছোট কুঠুরিটার বর্ধনশীল দেওয়ালে আছে এবং সেটাকে যতদূর খুশি বাড়ানো যায় এ ধারণা কিন্তু ভুল। ঠিক জানবে, এমন একসময় আসে যখন নতুন কোন জ্ঞান পেতে হলেই পুরনো জ্ঞান কিছুটা ছাড়তে হবেই। কাজেই অদরকারী ঘটনা যাতে দরকারী ঘটনাকে মন থেকে ঠেলে সরিয়ে না দেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।‘

 

‘কিন্তু সৌরজগৎ!’ আমি প্রতিবাদ করলাম।

 

অসহিষ্ণুকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘তা দিয়ে আমার কি দরকার? তুমি বলছ আমরা সূর্যের চারদিকে ঘুরিছি। বেশ তো, আমরা যদি চন্দ্রের চারদিকে ঘুরতাম তাতে আমি বা আমার কাজের তো তিলমাত্র তফাৎ হত না।‘

 

তার কাজটা কি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার হাবভাবে মনে হল প্রশ্নটাকে সে ভালভাবে নেবে না। যা হোক, আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার কথা ভাবতে ভাবতে তার থেকে কিছু কিছু তথ্য অনুমান করতে চেষ্টা করলাম। সে বলেছে, তার অভীষ্টের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কোন জ্ঞান লাভ করতে সে চায় না। অতএব যা কিছু … (এখানে কিছু অংশ পাঠোদ্ধার করা যায় নি বলে আপাতত মিসিং) …না হেসে থাকতে পারলাম না। তালিকাটি এইরূপ:

 

শার্লক হোমস—তার জ্ঞানের সীমা

 

১. সাহিত্যের জ্ঞান—শূন্য

 

২. দর্শনের জ্ঞান—শূন্য

 

৩. জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান—শূন্য

 

৪. রাজনীতির জ্ঞান—দূর্বল

 

৫. উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞান—পরিবর্তনশীল


Rx Munna

446 Blog Mesajları

Yorumlar