এপ্রিলের চার তারিখ। আমার চলে যাবার দিন। এয়ারফ্রান্সে প্যারিস থেকে ব্যাংকক, থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা, কলকাতায় কদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা। যারা আমাকে প্যারিসে এনেছেন, তাদের আজ প্যারিসের দিকে হাত নেড়ে আমার বলতে হবে, প্রিয় প্যারিস, তোমাকে বিদায়, প্রিয় প্যারিস, জ তেম। ত্রিশ্চান বেস আমার যাবার খবর শুনে হোটেলে চলে এলেন। সই করার জন্য কনট্রাক্ট ফরম এনেছেন ক্রিশ্চান। সই করার পর বললেন, পৌঁছেই যেন তাঁকে কোরানের নারী যে বইটি মাত্র লিখে শেষ করেছি, পাঠিয়ে দিই। নাতালি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরে দিচ্ছে। অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, হল না। সময়ের অভাবে হল না। ক্রিশ্চান বেস কে পই পই করে বলে দিয়েছি, আমার লেখা কোনও ফরাসি জানে এমন বাঙালিকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন। ক্রিশ্চান কথা দিয়েছেন যে তিনি তাই করবেন, তবে লজ্জার অনুবাদ জ্যঁ শার্ল প্রায় শেষ করে এনেছেন, এটি নতুন করে অনুবাদ করার সম্ভবত প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই, এ কথা আমি ঠিক মেনে নিই না।
প্যারিস ছেড়ে চলে যাবো, ভাবতেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। জানি না আর কখনও আসা হবে কী না প্যারিসে, হয়ত কোনওদিনই আর হবে না। অথবা হলেও এত ভালবাসা এত আদর হয়ত পাবো না।
ক্রিশ্চান বললেন, কাল তোমার আর্তে অনুষ্ঠান দেখলাম। কে ছিল তোমার অনুবাদক?
— না। ওরাই যোগাড় করে নিয়েছিল। তবে শুনেছি যে মেয়েটি অনুবাদ করেছে, ওর বাবা ফরাসি, আর মা বাঙালি। খুব ভাল বাংলা যে বলতে পারে তা নয়। শক্ত শক্ত শব্দ বুঝতে পারে বলে মনে হয়নি।
ক্রিশ্চান বলল, তোমার আসলে ইংরেজিতে বলা উচিত।
আমার ইংরেজির যে হাল! কোনওরকম কাজ চালাই। এ দিয়ে কোনও সাক্ষাৎকার চলে না। ওরাই বলে আমাকে বাংলায় বলতে।
–কী বল তোমার ইংরেজির হাল খারাপ। সেদিন দুপুরে নোভেল অবজারভেটরের জ্যঁ দানিয়েলের সঙ্গে বেশ গুছিয়ে তো বললে। তোমার লেখালেখি, তোমার সংগ্রাম। সময় পেলে তুমি বেশ সুন্দর বলতে পারো। এখন থেকে সিদ্ধান্ত নাও তুমি ইংরেজিতে দেবে যে কোনও সাক্ষাৎকার।
–দেখ, আমাদের দেশে ইংরেজি চর্চা একেবারেই নেই। মুখে বলতে গেলে দেখি অভ্যেস না থাকায় শব্দ খুঁজতে হয়।
–তোমার বক্তব্য যেন সব জায়গায়, যেখানেই কথা বলছ, স্পষ্ট হয়, সে কারণেই বলছি। কারণ অনুবাদক, ধরো হঠাৎ করে একজন অনুবাদক পেলে, তোমার চিন্তাচেতনাবিশ্বাস সম্পর্কে যার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সে তোমাকে, তুমি যাই বল, ভাল বুঝতে পারবে না। অনুবাদও করতে পারবে না।
ক্রিশ্চান গম্ভীর হয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি যেমন ভাল, তাঁর সহমর্মিতাও দেখার মত। সুটকেস গোছাতে গোছাতেই কথা বলছিলাম ক্রিশ্চানের সঙ্গে।
হঠাৎ পার্কার কলমটি খুঁজে পাচ্ছি না। ক্রিশ্চান ঢুকে গেল তাঁর ওই মিনিস্কার্ট পরা শরীর নিয়ে খাটের তলে, নাতালি আতি পাতি করে খুঁজছে, আর চুক চুক করে দুঃখ করছে, ক্রিশ্চান খুঁজছে আর বলছে, কি রকম রং বল, আমি দৌড়ে দোকানে গিয়ে এক্ষুনি কিনে নিয়ে আসছি। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষ অবদি পাওয়া গেল কলম যে শার্টটি পরা ছিলাম, তার পকেটে।
আবারও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের কথা ওঠালেন ক্রিশ্চান। বললেন, তোমার বিশ্বাস আর আদর্শ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু আর্তের অনুষ্ঠানে তোমার বক্তব্য খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি। আরেকটি কথা, তুমি যখন মৌলবাদিদের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব কর, এর পেছনে তুমি কোনও ভাল যুক্তি দেখাতে পারো না। আমি বললাম, কেন, আমি তো বলেইছি যে মৌলবাদীরা সমাজকে পেছন দিকে টানছে। নারী পুরুষের সমান অধিকার মানে না তারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে, ওদের পুড়িয়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। মুক্ত বুদ্ধির যে কোনও মানুষের ওপর হুমকি আসছে। ধনী আরব দেশগুলো থেকে টাকা আসে তাদের কাছে, হাতে তাদের অস্ত্র। মাদ্রাসা গড়ে উঠছে প্রচুর, আর মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর বেরোচ্ছে অগুনতি মৌলবাদী। এরা দেশের সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই করছে না। একসময় আমাদের দেশে তো ছিলই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। সেরকম তো আবার হতে পারে!