সুন্দরবন যাইমু এই খবরে ঘরটাই হইয়া গেল একেবারে আনন্দের মেলা। আম্মা ব্যাগ গোছাইতাছেন, আব্বা বারবার লিস্ট মিলাইতাছেন, আর আমি আর ছোট ভাই তাড়াতাড়ি মোবাইল চার্জ দিতেছি, ছবি তুলতে তো মোবাইল দরকার পড়ব! আগের রাত হইতেই ঘুম আইল না কারো। একদিকে আনন্দ, আরেকদিকে উত্তেজনা—এইটাই জীবনে প্রথমবার এত বড় ভ্রমণে যাইতেছি পুরো পরিবার নিয়া।
রাত ১০টার সময় আব্বা ডাক দিল, “বইন, গাড়ির সময় তো বাইলা যাইতেছে, সবকিছু রেডি তো?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, ছোট ভাইয়ের চশমা আর চার্জারটা নিয়া লইছি।” আম্মা আবার কইল, “চিনির কৌটা নিয়েছো? ওইটা ছাড়া ভাইয়ারে কিছু খাওয়ানো যায় না।”
ঘরে ঘরে হইচই পড়ে গেল। এক বেলা পরে সবাই একসাথে বাইরে যাইতেছে – এইটাই সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। ছোট ভাই খুশিতে কইল, “আম্মা, আমি বাঘ দেখব, আমি মাছরাঙা দেখব!” আমরা হাসতে লাগলাম। কিন্তু আসলে আমরাও জানি না সামনে কী আসতেছে।
রাত ১২টার দিকে আমাদের গাড়ি আসল। ময়মনসিংহ থেইকা ঢাকায় যাব ট্রেনে, তারপর বাসে খুলনা, তারপর সুন্দরবনের লঞ্চে উঠমু। বাইরের ঠান্ডা বাতাস আর জোৎস্না মিশা পরিবেশে এক ধরনের শান্তি। আব্বা সিটে বইসা বললেন, “শুরু হইল রে ভাই, আমাদের সুন্দরবন অভিযান!”
আমরা জানালার ফাঁক দিয়া বাইরের অন্ধকারে তাকায়া রইলাম। রাস্তার লাইট, ফাঁকা পথ, আর গাড়ির আওয়াজ—এই সব কিছুর মাঝে একটা অন্যরকম অনুভূতি।
ভ্রমণ তো এখনো শুরুই হইল না ঠিক মতো, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একরাশ আনন্দ বইতাছে। যেন জীবনের এক নতুন পাতা উল্টাইতেছি। আব্বা চুপচাপ বইসা বাইরের অন্ধকারের দিকে চাহি আছেন, মুখে একটু হাসি। কইলেন, “আমিও তোমার বয়সে ট্রেনে উঠা লইয়া এত খুশি আছিলাম। কিন্তু তখন তো এতো সুবিধা আছিল না।”
আম্মা ব্যাগ থেইকা কিছু সেদ্ধ ডিম আর পাউরুটি বাইর করলেন, “এই খাও, না খাইলে ট্রেনের দোকানদাররা যা দিব, তাই খাইতে হইব।”
সবাই একসাথে খাইতেছি, হালকা আলো, হালকা শব্দ, আর ট্রেনের কাঁপুনি – এই মুহূর্তটা জীবনের মণিরত্ন। ছোট ভাই খাইতে খাইতে ঘুমাইয়া পড়ল আমার কাঁধে। আমি জানালার ফাঁক দিয়া চেয়ে আছি অন্ধকারে, হয়তো কোনো শিয়াল, হয়তো কোনো রাতচরা পাখি আমাদের দিকে চাহি আছে।
এই যাত্রা একেবারে শুরু হইছে, আর এখনই মনে হইতেছে—এই ভ্রমণ শুধু গন্তব্য না, একেকটা মুহূর্তই স্মৃতি হইয়া থাকব আজীবন।
