নৌকার যাত্রা শেষ হইয়া আমরা নামছি একটা ছোট্ট ঘাটে। সামনে বনের ভিতর ঢুকার পথ – বাঁশের তৈরি ছোট একটা পুল, আর তার পরেই মাটির রাস্তা। গাইড ভাই কইল, “এখন একটু হাইক করুম, প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটতে হইবো। সবাই লাইনে থাকেন, কথা কম বলেন, আর চোখ-কান খোলা রাখেন।”
আমরা হাটতাছি ধীরে ধীরে। চারপাশে ঘন গাছ, মাথার উপরে পাতায় পাতায় আলো-ছায়ার খেলা। পায়ের নিচে শুকনা পাতা খচখচ করে আওয়াজ করে, মাঝে মাঝে দূরে কোন অচেনা পাখির ডাক কানে আসে। এইটা একেবারে সিনেমার মতন মনে হইতেছিল।
গাইড ভাই হঠাৎ থামাইয়া কইল, “এইডা বাঘের পায়ের ছাপ, ক্যালা!” আমরা তাকায়া দেখি – কাদার উপর বড় একটা চাপ, একেবারে পরিষ্কার। পাঁচটা থাবা, মাঝখানে ভারী দাগ। আব্বা কইল, “নিশ্চয় কালকে রাতে গেছে এই দিক দিয়া।” সবাই একটু থমথম করিয়া গেল, ছোট ভাই মায়ের হাত শক্ত কইরা ধইরা বলল, “আম্মা, এইদিকে চলেন না আর!”
আমি তাকাইয়া ছিলাম সেই ছাপের দিকে – সেইখানেই দাঁড়াইয়া বুকের ভিতর কেমন করতেছিল। ভাবতেছিলাম, এই বনে সত্যিই একটা রাজা আছে, আর আমরা তার রাজত্বে প্রবেশ করছি।
চলতেছিলাম আরো ভিতরে। মাঝপথে একজায়গায় দেখলাম কাঠের তৈরি ওয়াচ টাওয়ার। গাইড ভাই কইল, “এইটা উঠে দেখেন, উপরে থেইকা গহীন বন দেখা যায়।” আমরা একে একে ওপরে উঠলাম। উপরে দাঁড়ায়া চারপাশে তাকাইয়া দেখি – যতদূর চোখ যায়, শুধু গাছ, নদী আর সবুজে ঢাকা এক জগৎ। দূরে কোথাও কোথাও হরিণ, আর গাছের ফাঁকে বানরদের লাফালাফি।
আমার মন চায়তেছিল এইখানেই বসে থাকি সারাটা দিন। আব্বা কইল, “এইটা যদি শহরের জীবন হইতো, তাইলে রোজ সকালে চোখ খুলে এই দৃশ্য দেখতাম।” আম্মা মাথা নাড়ায়া বলল, “তাহলে আর মুঠোফোনে পইরা চোখ নষ্ট হইতো না।”
ওয়াচ টাওয়ার থেইকা নামার পর সবাই একটু ক্লান্ত, গাইড ভাই বলল, “চলেন, এখন আবার নৌকায় ফিরি, এই দুপুরে আরেক জায়গায় যামু।” আমরা হাঁটতে হাঁটতে আবার পুল পার হইলাম, পিছনে তাকাইয়া দেখি – সেই বাঘের ছাপ, সেই নিঃশব্দ বন, আর সেই ছায়া-মাখা স্মৃতি – সব আমাদের সঙ্গী হইয়া থাকবো।