ওয়াচ টাওয়ার থেইকা নামার পর আবার নৌকায় উঠলাম। এবার খালের পথ আরও সরু, দুপাশে গাছগুলাই এত কাছে যে হাত বাড়াইলেই ছুইতে পারি। গাইড ভাই কইল, “এই খালটার নাম মধুখালী, এইখানে কুমির দেখা যায় মাঝে মাঝে।”
ছোট ভাই কইল, “কুমির দেখলে কি করুম?” গাইড ভাই হাসি দিয়া বলল, “চুপ থাইকো, নড়াচড়া কম কইরো, তয় কিছু হইব না।” আম্মা একটু চিন্তিত হইল, তবে আব্বা কইল, “স্মৃতি হইব, আর কিছু না।”
নৌকা ধীরে ধীরে আগাইতেছে। গাছের ফাঁক দিয়া আলো পড়তেছে পানির গায়ে, পাখিরা একেকটা সুর তুলতেছে। হঠাৎ ডান পাশে এক ফালি কাদা দেখা গেল, আর সেইখানে একটা কুমির রোদ পোহাইতেছে। বিশাল দেহ, পিঠে কাঁটার মত খাঁজ, আর চোখ দুটো চুপচাপ আমাদের দিক তাকায়া আছে।
আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ কইরা তাকায়া রইলাম। ছোট ভাই একটু আম্মার পেছনে গিয়া লুকাইতেছিল। আমি ক্যামেরা বাইর করলাম, আস্তে আস্তে জুম কইরা ছবি তুললাম। কুমিরটা একটু নড়ল, তারপর আবার ঠান্ডা। গাইড ভাই কইল, “এইগুলা সুন্দরবনের লবণপানি কুমির, কিন্তু এইখানে খালটা একটু মিষ্টি পানি, তাই ওরা রোদ খাইতে উঠে আসে।”
কুমিরটা দেখতে দেখতে হঠাৎ বাঁ পাশে একটা চিৎকার – “ওই দেখেন, পাখি!” আমরা তাকাইলাম – গাছের ডালে দুইটা লাল-হলুদ রঙের পাখি বসা। গাইড ভাই কইল, “এইডা রঙমালা টিয়া। খুব বিরল দেখা যায়।” ওদের রঙ এত উজ্জ্বল যে মন ভইরা গেল। আমরা আস্তে আস্তে নৌকায় বইসা সেই রঙিন দৃশ্য দেখতে লাগলাম, যেন এক ছবি চোখের সামনে।
নৌকা আরো ভিতরে গেলে কিছু পাখি পানিতে নামত, আবার উড়ে গাছের ফাঁকে হারায়া যাইত। এক জায়গায় দেখি পানির উপরে ছায়া পড়া গাছে বসা একটা মাছরাঙা পাখি – টুকটুকে নীল আর বুক সাদা। গাইড ভাই বলল, “এই পাখিটা দেখলে বুঝবেন, এইখানে মাছ আছে।” সত্যিই, একটু পরেই দেখি পাখিটা পানিতে ঝাঁপ দিয়া একটা ছোট মাছ বাইর কইরা নিল!
এই অভিজ্ঞতা আমাদের কারো জীবনে প্রথম। এত নিকট থেইকা কুমির আর এত রঙিন পাখির দেখা — শহরে থেকেও এতদিন কিছুই দেখি নাই।
নৌকা যখন ফিরতেছিল লঞ্চের দিকে, তখন মনে হইতেছিল, সুন্দরবন আমাদের কাছে শুধু একটা বন না — একটা জীবন্ত কল্পনালোক, যেখানে প্রকৃতি আপন হইয়া ধরা দেয়।