দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে হিটলারের নাৎসি বাহিনী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লেলিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) অবরোধ করে। এই অবরোধ চলেছিল প্রায় ৯০০ দিন, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর ধরে। ইতিহাসের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে ভয়াবহ অবরোধগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই সময়ে শহরের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছিল অনাহার, ঠাণ্ডা এবং অসুস্থতার কারণে।
শহরটি পুরোপুরি অবরুদ্ধ ছিল। বাইরে থেকে কোনো খাবার, জ্বালানি, বা ঔষধপত্র ঢোকার উপায় ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ নেই, জলের সরবরাহ বন্ধ। শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেত। মানুষজন ঘাস, গাছের ছাল, এমনকি ওয়ালপেপার থেকে আঠা তুলে খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত। রাস্তার কুকুরের মাংস এবং পাখির মাংসও মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও, লেলিনগ্রাদের মানুষ অবিশ্বাস্য সাহস এবং সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো লেলিনগ্রাদ উদ্ভিদবিদ্যা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (Vavilov Institute of Plant Industry) কর্মীদের আত্মত্যাগ। এই ইনস্টিটিউটে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বীজ ব্যাংক ছিল, যেখানে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও ফসলের বীজ সংরক্ষিত ছিল। এই বীজগুলো ছিল ভবিষ্যতের খাদ্য সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবরোধের সময়, ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এবং কর্মীরা অনাহারে ধুঁকে মরে যাচ্ছিলেন। তাদের সামনে ছিল লক্ষ লক্ষ ক্যালোরি সমৃদ্ধ শস্যবীজ, যা তাদের জীবন বাঁচাতে পারতো। ক্ষুধার্ত পেটে তারা দিনরাত এই বীজগুলোকে ইঁদুর, পোকামাকড় এবং সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন। এমন অসংখ্য কর্মী ছিলেন যারা অনাহারে মারা গেছেন, কিন্তু একটিও বীজ খাননি। কারণ তারা জানতেন, এই বীজগুলো শুধু তাদের ব্যক্তিগত খাবার নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা। তাদের এই আত্মত্যাগ মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অবরোধ চলাকালীন, একমাত্র যে রাস্তাটি আশার আলো দেখিয়েছিল, সেটি ছিল লাদোগা হ্রদের উপর দিয়ে তৈরি "লাইফ রোড" বা "জীবন পথ"। শীতকালে হ্রদের জল জমে বরফ হয়ে যেত, আর তার উপর দিয়ে তৈরি হতো অস্থায়ী রাস্তা, যার উপর দিয়ে ট্রাক করে সামান্য খাবার এবং রসদ শহরে আনার চেষ্টা করা হতো। এটি ছিল এক মরণফাঁদ। জার্মান বোমা হামলায় বরফ ভেঙে কত ট্রাক যে হ্রদের গভীরে তলিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে সেই পথ দিয়েই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ চলাচল করত।
অবরোধ যখন শেষ হলো, ১৯৪৪ সালের ২৭শে জানুয়ারি, লেলিনগ্রাদের মানুষ দেখেছিল এক অবিশ্বাস্য জয়। তারা শুধু একটি সামরিক যুদ্ধে জেতেনি, তারা জিতেছিলে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে। তাদের মনোবল, ঐক্য এবং অসাধারণ আত্মত্যাগ আজো মানবজাতির ইতিহাসে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। লেলিনগ্রাদের প্রতিরোধ শুধু একটি শহরের গল্প নয়, এটি মানবজাতির অদম্য প্রাণশক্তি এবং সহনশীলতার এক মহাকাব্য।
আশা করি গল্পটি আপনার ভালো লেগেছে। এটি সত্যিই ইতিহাসের এক অসাধারণ অধ্যায়।