রাজা ও দর্পণ
এক রাজা ছিল, যে খুব গর্বিত ছিল নিজের সৌন্দর্য নিয়ে। তার শরীর সুঠাম, মুখশ্রী অপূর্ব, আর গালে ছিল হালকা দাড়ির ছায়া। রাজ্যজুড়ে লোক বলত, “আমাদের রাজা যেন স্বর্গের দেবতা!” রাজা নিজের দরবারে একটি বড় আয়না বসিয়েছিল, যাতে সে দিনে কয়েকবার নিজেকে দেখে প্রশংসা করত।
একদিন এক দরিদ্র বৃদ্ধ এসে বলল, “মহারাজ, আমি এক বিশেষ দর্পণ বানাতে পারি। তাতে আপনি শুধু রূপ নয়, আপনার প্রকৃত চরিত্রও দেখতে পাবেন।” রাজা আগ্রহী হলেন। বললেন, “তুমি তৈরি করো, যদি সত্যি এমন দর্পণ বানাও, পুরস্কার দেব।”
বৃদ্ধ দর্পণ তৈরি করল—একটি সাধারণ কাচ, কাঠের ফ্রেমে বাধা। রাজা সেটি দেখার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু এবার নিজেকে দেখে সে চমকে উঠল। চেহারা ঠিক আগের মতোই, কিন্তু চোখে যেন অহংকার, ঠোঁটে তুচ্ছতা, মুখে দাম্ভিকতা ফুটে আছে।
রাজা চিৎকার করে উঠল, “এ তো আমাকে বিকৃত করে দেখায়! আমি তো এমন নই!” বৃদ্ধ শান্তভাবে বলল, “মহারাজ, এটি বিকৃত করে না, বরং যা আপনি ভিতরে লুকিয়ে রাখেন, সেটিই বাহিরে তুলে ধরে। আপনি নিজেকে দেবতা ভাবেন, কিন্তু অভ্যন্তরে আপনি মানুষের দম্ভে ভরা।”
রাজা স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমাকে আমার প্রকৃত রূপ দেখালে। এতদিন আমি আয়নায় দেখতাম বাহ্যিক সৌন্দর্য, আজ দেখলাম অন্তরের কালো দাগ।”
সেদিন থেকে রাজা প্রতিদিন সকালে সেই দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন, “আমি আজ মানুষ হিসেবে কতটা উন্নত হলাম?”
#sifat10
সাপ ও বাঁশিওয়ালা
এক ছোট্ট গ্রামে হঠাৎ একদিন দেখা গেল, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর একটা বড় সাপ এসে গ্রামের পথঘাট দখল করে নেয়। লোকজন ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতো না। দোকানপাট বন্ধ, মেলামেশা বন্ধ, যেন এক আতঙ্কগ্রস্ত জনপদ।
গ্রামবাসীরা অনেক চেষ্টা করল—ওঝা আনল, আগুন জ্বালাল, লাঠি নিয়ে তাড়া দিল—কিন্তু কিছুতেই সাপটা পালায় না। বরং গর্জে উঠে, ফণা তোলে, মানুষ তাড়া করে। একসময় সবাই হাল ছেড়ে দিল।
তখন একদিন, বাইরে থেকে এক বাঁশিওয়ালা এল। পরনে ছেঁড়া জামা, চোখে চঞ্চল দৃষ্টি। সে বলল, “আমি শুনেছি, এখানে এক ভয়ংকর সাপের উপদ্রব চলছে? আমি সেটা তাড়াতে পারি, তবে কিছুই চাই না—শুধু যদি এক বেলা খাবার দাও।”
লোকজন তাকে অবিশ্বাস করল। কেউ বলল, “তুই কি ওঝা? না পাগল?” বাঁশিওয়ালা হাসল, “আমি স্রেফ একজন বাঁশিওয়ালা।”
সেদিন সন্ধ্যায় সে গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতে শুরু করল। মধুর, মনকাড়া সুর। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল, সেই ভয়ঙ্কর সাপটা যেন মোহিত হয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সাপটা আর কাউকে ভয় দেখাল না, ফণা তুলল না, বরং বাঁশির সুরে দুলতে লাগল।
বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাতে বাজাতে গ্রাম থেকে দূরের এক জঙ্গলের দিকে হাঁটল। সাপ তার পেছনে পেছনে চলল। সবাই নিঃশ্বাস আটকে দেখল। যখন সে সাপকে দূরে নিয়ে গিয়ে বাঁশি থামাল, তখন সাপটা গর্তে ঢুকে আর বের হলো না।
গ্রাম আনন্দে ফেটে পড়ল। এক বুড়ো বলল, “কী জাদু করলি?” বাঁশিওয়ালা হেসে বলল, “জাদু নয়, সুর। ভয়কে ভয় না দেখিয়ে যদি মায়া দেখাও, তখন সে আপনিই শান্ত হয়ে যায়।”
সে শুধু এক থালা খিচুড়ি খেয়ে হেসে হেসে চলে গেল।
#sifat10