সরস্বতী খালটা নৌকা চলাচলের মতো চওড়া করে কাটা হয়েছে দেখে আমার মাথায় চাপল নতুন খেয়াল। আচ্ছা, এই খালপথে অভিযানে বেরোলে কেমন হয়!
খেয়াল পেশ করলাম ‘সবুজ বাহিনী’র কাছে। তার আগে জানতে চাইলাম, ওদের কেউ এ ক’দিনের মধ্যে মাঠের দিকে গিয়ে বড় বড় হাইড্রলিক মেশিনের সাহায্যে সরস্বতী খালের সংস্কার হওয়া খেয়াল করেছে কি না। ওরা সবাই ঘাড় নেড়ে ‘না’ জানাতে বললাম, “খালটার কী দশাই না হয়েছিল! কচুরিপানায় পুরো ঢেকে যাওয়ায় সেটা যে আছে, বোঝাই যেত না।”
তারপর আসল কথায় এলাম, “জানিসই তো আমাদের এখান থেকে পিচরাস্তা ধরে ডোমজুড় তিন কিলোমিটার। কিন্তু আগেকার দিনে জলপথে সেটা কত কিলোমিটার ছিল বা যেতে কতটা সময় লাগত, তা কিন্তু আমাদের জানা নেই। এখন খালে জল নেই। আর খালটাও চওড়া করে কাটা হয়েছে। তাই চাইলে ডোমজুড় বা নৌ-চলাচলের সময় যাকে বন্দর বলা হত, খালপথে আমরা সেখানে পৌঁছে যেতে পারি। ভেবে দ্যাখ, যে-খালে একসময় নৌকা চলেছে, সেই খালে নেমেই আমরা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছি অভিযানে! ভাবলেই রোমাঞ্চ হচ্ছে না? কী, এমন অভিযানে বেরোতে তোরা রাজি?”
সবাই ঘাড় নাড়ল। শুভম বলল, “আমাদের এই অভিযানের নাম কী হবে?“
“সব অভিযানের কি আলাদা নাম হয়! উঁহু… ঠিক আছে, তোর অনারে এই অভিযানের নাম হোক— ‘এক্সপিডিশন অভিযান‘।“
“বাবা, তুমি সবাইকার সামনে খালি আমার লেগ পুল করো!”
শুভমের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বাকি সকলের দিকে ফিরে বললাম, “তোরা কে কে এই অভিযানে বেরোতে চাস?“
দেখলাম হাত উঠল ছ’টা। একটা হাত শুভমের।
“ঠিক আছে। কিন্তু শোন, শুধু তোরা বললে তো হবে না, বাড়ির অনুমতি দরকার। বুধবার সকালে তোরা জানিয়ে দিস কে কে বাড়ির অনুমতি পেলি। আমরা কিন্তু রওনা দেব শুক্রবার সকাল আটটায়।“
বুধবার সকালে দীপ এবং অয়ন জানাল, তাদের বাড়ি অনুমতি দেয়নি।
অতঃপর স্থির হল অভিযানে বেরোব পাঁচজন— সুজন, অনির্বাণ, প্রমথেশ এবং আমরা পিতা-পুত্র।
গুড ফ্রাইডের সকাল আটটায় অভিযানের শুভারম্ভ। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকেই শুভম কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিল। চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। এই প্রথম ও চেনা পথ ছেড়ে অচেনা পথে পা বাড়াবে। আগ্রহ-প্রত্যাশা-রোমাঞ্চ—সব মিলেমিশে শুভমের বডি ল্যাঙ্গুয়েজই যেন বদলে গেছে। মনে মনে বললাম, কাম অন চ্যাম্প, এই না হলে অভিযান!
আটটায় অনির্বাণ এল। সাড়ে আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন বাকি দু’জন এল না, আমি বললাম, “চল, আমরা তিনজনেই বেরিয়ে পড়ি।“
মার্চ মাসের সকাল। মোটামুটি গরম। রোদের তাপ এখনও চামড়া সেঁকে দেওয়ার মতো নয়। তাই ছাতা নিলাম না। শুধু দেড় লিটারের দু’টো বোতলে জল ভরে নিয়ে— ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো আমরা অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম।
পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কখনও এমন অভিযানে বেরিয়েছে কি না জানি না! আদৌ এটা অভিযান পদবাচ্য কিনা, সে সম্পর্কেও সম্যক ধারণা নেই। তা সত্ত্বেও এটা আমাদের কাছে প্রথম অভিযান। ছত্রিশ, পনেরো আর নয় বছরের তিন অসমবয়সী বাঙালির এক অতি সামান্য অভিযান। কিন্তু তা যত নগণ্যই হোক, অভিযান তো বটেই!
মাঠের রাস্তা ধরে খাল পর্যন্ত গিয়ে, সোজা খালে নেমে পড়লাম। খালের গর্ভ দিয়ে না–গেলে সোজা বন্দরে যাওয়া সম্ভব নয়। খালের পাড় বরাবর দু’-ধারের রাস্তায় যে–সব পথ এসে মিশেছে, তার সব ক’টাতে যাওয়া না-থাকলেও অধিকাংশই চেনা। কিন্তু এই যে খালের নীচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া— এর অনুভূতিই আলাদা। খাল দিয়ে সোজা নাক বরাবর যেতে পারার কারণে একটা অদ্ভুত ভাললাগাও তৈরি হচ্ছিল।
মিনিট পাঁচেক হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ঈশান পাড়ুইয়ের পোলে, এখন যেখানে কংক্রিটের ব্রিজ হয়েছে। এতদিন আমার কাছে সরস্বতী খাল শুধু এটুকুই ছিল। আজই প্রথম তা অনেক, অনেক প্রসারিত হয়ে নিজেকে মেলে ধরল।
ছেলেবেলায় নাবোতলার মাঠে খালের ধারে আসা… দোলের দিন রং মেখে ভূত হয়ে খালের জলে স্নান… সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠার চেষ্টায় খালের বুকেই সাঁতার শেখা… সাঁতার শিখে গ্রীষ্মদুপুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলে দাপাদাপি… কচুরিপানা জড়ো করে মান্দাস বানিয়ে জলের ওপর ভেসে থাকা… বাঁশের লগি খালের পাড়ে অথবা জলের গভীরে মাটিতে ঠেকিয়ে চাপ দিয়ে মান্দাস করে জলের ওপর ঘুরে বেড়ানো… অলস দুপুর-বিকালে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে আসা লোকের কাছে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা… খালের এক-একটা ডোবাতে জল শুকোলে ঘোলাজলে-পাঁকে সকলে মিলে মাছ ধরা…
আজ এই মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হাঁটতে সেই সমস্ত দিনের কথা মনে এমন ঘাই মারছিল, মনে হচ্ছিল ছেলেবেলায় এই জলভাগ আমার কাছে খাল ছিল না, ছিল নদী, সাগর, অথৈ দরিয়া!
মিনিট পনেরো হাঁটার পর শুভমের দিকে তাকিয়ে দেখি কোথা থেকে একটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে ও নিজের মনে হেঁটে চলেছে।
কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, “ব্রেক। আয়, একটু জল খেয়ে নিই।“
তিনজনেই জল খেলাম। বিশ্রাম নেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই… আবার শুরু করলাম হাঁটতে।
আমার মনে পড়ল— ঈশান পাড়ুইয়ের পোলের পশ্চিমদিকের এই মাঠে ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াতে খুব পছন্দ করত। আমার ঘুড়ি ছিল না, ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম না। ঘুড়ি কেটে গেলে দেখতাম ছেলের দল হাতে বাঁশের লগা অথবা কঞ্চি নিয়ে কাটা ঘুড়ির পিছনে— কত জমি তারা পেরিয়ে যেত, কেউ মাথায় মোটা করে সুতো জড়িয়ে ফিরত, আবার কেউ ফিরত কাটা ঘুড়ি লুটে নিয়ে।
এসে পড়লাম দক্ষিণরায়তলা। তাই তো, জায়গাটার নামের মধ্যেই যে তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে এ কথা তো আগে কোনওদিন ভাবিনি! দক্ষিণ রায় তো বাঘের দেবতা! এটা দক্ষিণবঙ্গ হলেও সুন্দরবন থেকে এ–জায়গার দূরত্ব একশো কিলোমিটারের বেশি। তবে কি রয়াল বেঙ্গল টাইগার না হলেও ছোটখাটো বাঘের দেখা আগে এসব অঞ্চলেও পাওয়া যেত!
নিজের চোখে দেখেছি— খাল থেকে প্রায় দু’শো মিটার দূরত্বে বাঁদিক বরাবর চওড়া বাঁধের মতো উঁচু মাটির ঢিপি। দক্ষিণরায়তলায় যেখানে এসে মাটির এই চওড়া বাঁধ শেষ হয়েছে, তার বাঁ দিকে বাঁশবাগানের মধ্যে অনেক উঁচুতে আছে মনসার থান। তার মানে সর্প এবং ব্যাঘ্র— এককালে উভয়

somrat222
10 Blog des postes
Modifier loffre
Ajouter un niveau
Supprimer votre niveau
Avis
Payer par portefeuille
Alerte de paiement
Vous êtes sur le point d'acheter les articles, voulez-vous continuer?